খাতায়কলমে ‘রাজা’ না হলেও পারিবারিক ঐশ্বর্য ও আভিজাত্যে উজ্জ্বল রাজপরিচয়। মাত্র ২০ বছর বয়সেই অগাধ সম্পত্তির মালিক তিনি। রাজপুরুষ হওয়ার পাশাপাশি জয়পুর রাজ পরিবারের পদ্মনাভ সিংহ এক জন নামী পোলো খেলোয়াড়ও।
পদ্মনাভ সিংহ হলেন জয়পুর রাজ পরিবারের ৩০৩তম উত্তরাধিকারী। তাঁর বংশ জয়পুর শাসনের দায়িত্বে আছেন সেই দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। সে সময় এই প্রদেশের নাম ছিল অম্বর। উনিশ শতক থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতার আগে অবধি জয়পুর ছিল ব্রিটিশদের মিত্র রাজন্য স্টেট।
প্রাচীন অম্বরের শাসকরা ছিলেন পৃথ্বীরাজ চহ্বনের সৈন্যদলের গুরুত্বপূর্ণ যোদ্ধা। পরে তাঁরা রানা সঙ্ঘের হয়ে যুদ্ধ করেছেন বাবরের বিরুদ্ধেও। ষোড়শ শতকে অম্বরের শাসন দখল করে রাঠৌর বংশ।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে জয়পুরের সঙ্গে সম্পর্কের রসয়ান পাল্টে যায়। জয়পুরের তৎকালীন শাসক রাজা ভারমলের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরই পরে আকবরের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন।
সপ্তদশ শতকে জয়পুরের শাসক ছিলেন মহারাজা প্রথম জয় সিংহ। তাঁর প্রপৌত্র দ্বিতীয় জয় সিংহ জয়পুর শাসন করেছিলেন ১৬৯৯ থেকে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁকে সোয়াই জয় সিংহও বলা হত। রাজার পাশাপাশি তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। তাঁর নাম থেকেই অম্বর রাজ্যের নতুন নাম হয় ‘জয়পুর’।
এর পর থেকে জয়পুর রাজবংশের শাসকদের নামের আগে ‘সোয়াই’ হয়ে দাঁড়ায় চিরাচরিত উপাধি। এই উপাধির ধারক ছিলেন মহারাজা ভবানী সিংহ-ও। তিনি ১৯৭০ সালে সিংহাসনে বসেন। তিনিই ছিলেন খাতায়কলমে জয়পুরের শেষ মহারাজা। এর পর রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে স্বাধীন ভারতে।
মহারাজা ভবানী সিংহের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঘিরে চরম বিতর্ক দেখা দিয়েছিল রাজ পরিবারে। কারণ জয়পুরের রাজকন্যা, ভবানী সিংহের মেয়ে দিব্যাকুমারী বিয়ে করেছিলেন এক সাধারণ পরিবারের যুবক নরেন্দ্র সিংহকে। নরেন্দ্র সিংহের বাবা ছিলেন রাজা ভবানী সিংহের কর্মচারী।
এই বিয়ের পরে রাজপরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে যান দিব্যাকুমারী। পরে অবশ্য তাঁর সন্তান পদ্মনাভকে দত্তক নেন মহারাজ ভবানী সিংহ। ২০০২ সালে দৌহিত্রকেই নিজের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন তিনি। তখন পদ্মনাভর বয়স মাত্র ৪ বছর।
২০১১ সালে মহারাজ ভবানী সিংহের মৃত্যু হয়। তখনও পদ্মনাভ নাবালক। তাই তখন বিশাল এস্টেটের দেখভাল করতেন তাঁর দিদিমা পদ্মিনী দেবী। ১৮ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরে জয়পুর রাজবংশের ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী এখন পদ্মনাভ সিংহই।
প্রসঙ্গত পদ্মনাভর দাদুর বাবা অর্থাৎ প্রমাতামহ ছিলেন রাজা দ্বিতীয় মান সিংহ। তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন মহারানি গায়ত্রী দেবী। অর্থাৎ সম্পর্কে পদ্মনাভর সৎ প্রমাতামহী ছিলেন তিনি।
অজমেরের মেয়ো কলেজের পরে পদ্মনাভর উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ হয় নিউইয়র্ক এবং রোম থেকে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি সমানতালে চালিয়ে গিয়েছেন পোলো খেলাও। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ২৮০ কোটি ডলারেরও বেশি। পরিজনদের কাছে তিনি আদরের ‘পাচো’।
পদ্মনাভর বোনের নাম গৌরবী কুমারী এবং ভাইয়ের নাম লক্ষ্য রাজ সিংহ। তাঁদের মা দিব্যাকুমারী এক জন বিজেপি নেত্রী এবং লোকসভার সদস্য। তবে দাম্পত্যের ২১ বছর পরে নরেন্দ্র কুমারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে ভেঙে যায়।
পোলো খেলার পাশাপাশি ‘মহারাজা’ পদ্মনাভর প্রধান শখ বেড়াতে যাওয়া। ফ্যাশনেও তাঁর আগ্রহ আছে। ইতালির মিলানে নামী ফ্যাশন শো-এ অংশ নিয়েছেন তিনি। বিশ্বের প্রথম সারির ফ্যাশন ডিজাইনারদের অনেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাজপরিবারের রীতিনীতি অনুসারে বিভিন্ন ধরনের জনসেবার কাজেও তিনি যুক্ত।
ভারতীয় পোলো দলের হয়ে বিশ্বমঞ্চেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। সময় পেলেই ভালবাসেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে। সব থেকে পছন্দের দেশ ইতালি। তবে বিদেশি খাবারের মধ্যে তাঁর মন কেড়ে নিয়েছে জাপানের সুশি।
গোলাপি শহর জয়পুরে থাকলে পদ্মনাভ সিংহ থাকেন মূল প্রাসাদে। এ ছাড়াও সুজান রাজমহল প্যালেস এবং রাম নিবাসে তাঁর জন্য সাজানো আছে বিলাসবহুল ব্যক্তিগত মহল।
বিদেশি সংস্কৃতির অনুরাগী হলেও পদ্মনাভ সিংহ দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জয়পুর প্রাসাদে তাঁর হোলিখেলার দৃশ্য যথেষ্ট বর্ণময়। তরুণ এই রাজপুরুষ জানিয়েছেন, তিনি জয়পুরবাসীর জন্য কাজ করে যেতে চান।