জঙ্গিহানায় নয়, এ দেশে প্রেমসন্ত্রাসে প্রতি দিন প্রাণ হারাচ্ছেন আরও বেশি মানুষ। ভালবাসার জেরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে আত্মহত্যা, অপহরণ, খুনজখম। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম— প্রেমের বলিকাঠে চড়ছে দেশের নানা প্রান্ত। সম্প্রতি সরকারি ভাবেই এমন পরিসংখ্যান মিলল।
জঙ্গিহানায় প্রাণনাশ খবরের শিরোনামে থাকলেও প্রেমের কাছে হার মেনেছে তা। সরকারি রিপোর্টে প্রকাশ, ২০০১-১৫ এই পনেরো বছরে প্রেমঘটিত কারণে খুন হয়েছেন মোট ৩৮ হাজার ৫৮৫ জন। এর সঙ্গে যোগ করুন ৭৯ হাজার ১৮৯টি আত্মহত্যার বা ২ লক্ষ ৬০ হাজার অপহরণের ঘটনাও। অন্য দিকে, ওই সময়ের মধ্যে জঙ্গিহানায় নিহত হয়েছেন ২০ হাজার সেনাকর্মী বা সাধারণ নাগরিক। সরকারি ওই পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা গিয়েছে, প্রেমজনিত কারণে গড়ে প্রতি দিন ৭টি খুন, ১৪টি আত্মহত্যা ও ৪৭টি অপহরণের ঘটনা ঘটে।
প্রেমের ফাঁদে পড়েই হোক বা তাতে সাড়া দিয়ে সমাজের চাপে পিষে মরেছেন এমন মানুষজনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি অন্ধ্রপ্রদেশে। এর পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও মধ্যপ্রদেশের নাম। সরকারি এই রিপোর্টে পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গও। বরং অন্তত একটি ক্ষেত্রে এগিয়েই রয়েছে এ রাজ্য। পনেরো বছরের মধ্যে ২০১২-র সঠিক পরিসংখ্যান না মিললেও আত্মহত্যার ঘটনায় শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। গত চোদ্দো বছরে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা প্ররোচনার জেরে আত্মহত্যা করেছেন এ রাজ্যের ১৫ হাজার মানুষ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তামিলনাড়ু। সে রাজ্যে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ৯,৪০৫ জন। এই তালিকায় অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশও পিছিয়ে নেই। প্রতিটি রাজ্যেই ঘটে গিয়েছে ৫ হাজারের বেশি এমন
ঘটনা। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, দেশের ৩৫টির মধ্যে ১৯টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাষিত অঞ্চলে পুরুষদের তুলনায় মহিলারাই প্রেমের বলি হয়েছেন বেশি।
আরও পড়ুন
শরীরী ভাষায় আসে খদ্দের, স্টেশনেই চলে দেহ ব্যবসা!
কিন্তু, কেন ঘটে এমন ঘটনা?
কারণ হিসাবে টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রকাশিত প্রতিবেদনে জাতপাত ও পুরুষতন্ত্রকেরই দায়ী করছেন অধিকাংশ বিষেশজ্ঞ। সামাজিক পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে প্রচলিত ‘নিয়ম’ ভাঙার সাহস যাঁরা দেখিয়েছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই প্রেমসন্ত্রাসের শিকার বলে মত তাঁদের। তথাকথিত সামাজিক সম্মানের জন্যই আপোস করতে হচ্ছে বহু নারীকে। আর তাতে মদত যোগাচ্ছে খাপ পঞ্চায়েতের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানও। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক উমা চক্রবর্তী দীর্ঘ দিন ধরেই লিঙ্গভিত্তিক বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, বিয়ে করার মতো বিষয়েও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে হিংসার আশ্রয় নিচ্ছে অনেকে। মানুষের অস্তিত্বকে দমিয়ে রাখতে হিংসার আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতার পিছনে আসল কারণ খুঁজতে গেলে পিতৃতন্ত্র ও জাতপাতের সমীকরণটা আগে ভাল ভাবে বুঝতে হবে বলে দাবি তাঁর। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে সেখানকার মহিলাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাহিনি তথ্যচিত্রে তুলে ধরেছেন নকুল সিংহ সাহানে। ‘ইজ্জতনগরী কি অসভ্য বেটিয়াঁ’ নামে তথ্যচিত্রের পরিচালক নকুলের মতে, “এই আত্মহত্যার পিছনে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক মদত।”
আরও পড়ুন
তাওয়াং-এ ভারত ট্রেন পাঠালে ফল খারাপ হবে: আবার হুঁশিয়ারি চিনের
অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেন্স অ্যাসোশিয়েশনের জগমতী সাঙ্গওয়ানের মতে, সমাজে জাতপাত ও শ্রেণিভেদ বাঁচিয়ে রাখতেই হিংসাকে হাতিয়ার করছে কিছু স্বৈরাচারী প্রতিষ্ঠান। আর তাতে জড়িয়ে পড়া অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ানোর পরিবর্তে মদত দিচ্ছে রাষ্ট্রতন্ত্র।
এরই পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ে চিন্তিত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরা। সরকারি রিপোর্টে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের চেয়েও ওই সংখ্যাটা আরও বেশি বলে মত তাঁদের। পুলিশ-প্রশাসনের মদতই হোক সামাজিক চাপে— হরিয়ানা বা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের অধিকাংশ জায়গায় সামনেই আসে না আত্মহত্যা বা খুন-অপহরণের বহু ঘটনা।