গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
গুনা শহরে ঢোকার মুখেই বিগড়়ে গেল গাড়ি। গ্বালিয়র যেতে এখনও ৫-৬ ঘণ্টা। শিবরাজের (চালক) মুখ দেখে তাড়াতাড়ি কিছু হবে বলে মনে হল না। অগত্যা, গুনাতেই প্রায় এক ঘণ্টার বিরতি!
বিগত চার বার এই গুনা লোকসভা কেন্দ্র থেকেই কংগ্রেসের কেল্লা সামলাচ্ছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। এ বারও তিনি এখানকার প্রার্থী। গুনাই হোক বা গ্বালিয়র, সিন্ধিয়া রাজপরিবারের প্রভাব এখনও চোখে পড়ার মতো। প্রায় সন্ধের মুখে গ্বালিয়রে পৌঁছনোর পর তা আরও যেন স্পষ্ট হতে শুরু করল।
২০১৪ সালে গ্বালিয়র লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে ছিলেন নরেন্দ্র সিংহ তোমর। পরবর্তীতে নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভাতেও ঠাঁই হয় তাঁর। কিন্তু এই ক’বছরে নিজের কেন্দ্রের ভোটারদের মনে সে ভাবে ঠাঁই পাননি তিনি। গ্বালিয়রের মানুষ তাই ভোটের মুখে বলছেন, হাওয়া বুঝে নরেন্দ্র সিংহ তোমর ‘পালিয়ে’ মোরেনা আসনে লড়ছেন। এবং ওখানেও হারবেন।
মানুষের ভাবাবেগকে হাতিয়ার করে ‘কিংমেকার’ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ভোট ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জ্যোতিরাদিত্যের কথাতেই এই আসনে অশোক সিংহের উপরে ভরসা রেখেছেন কংগ্রেস হাইকমান্ড। গত বারের লোকসভা নির্বাচনে অশোক হেরে গেলেও ৪১.৬৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। আর বিজেপি-র নরেন্দ্র সিংহ তোমরের ভোট শতাংশ ছিল ৪৪.৬৮ শতাংশ। মাত্র ৩ শতাংশের ব্যবধান, খুব একটা বেশি নয়। তার উপর গত বছরের এপ্রিলে ভারত বন্ধের পর গ্বালিয়রের বিজেপি নেতৃত্ব যেন আরও কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: কিছুই বদলায়নি মন্দসৌরে, ঋণের বোঝা নিয়ে মাত্র ২ টাকায় পেঁয়াজ বেচতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক
গত বছর তফসিলি জাতি ও উপজাতি আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। আইনে আগে বলা ছিল, দলিত বা আদিবাসীদের তরফে অভিযোগ এলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে হবে। আইনের অপব্যবহারের কারণে অনেক সময় তার ফল ভুগতে হত নির্দোষ মানুষকে। সুপ্রিম কোর্ট তার নতুন রায়ে জানিয়ে দেয়, ‘এসসি/এসটি (প্রিভেনশন অব অ্যাট্রোসিটিস) অ্যাক্ট ১৯৮৯’-এর আওতায় কোনও অভিযোগ এলে তখনই কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যাবে না। দলিত সংগঠনগুলির অভিযোগ, কেন্দ্র কঠোর অবস্থান না নেওয়াতেই এমন রায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত৷
গ্বালিয়রের দলিত মহল্লাই স্বপ্ন দেখাচ্ছে কংগ্রেসকে। নিজস্ব চিত্র।
গোটা দেশের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের গ্বালিয়রেও তার আঁচ পড়তে শুরু করে। গাল্লাকোঠার বাসিন্দা দলিত যুবক দীপক মিত্তলও এই আন্দোলনে ঝঁপিয়ে পড়েন। তার খেসারত অবশ্য প্রাণ দিয়ে দিতে হয় দীপককে। রাজা চৌহান নামে স্থানীয় এক যুবকের গুলিতে বাবা-মায়ের সামনেই লুটিয়ে পড়েন দীপক। গাল্লাকোঠায় দীপকের ভাই সে দিনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। তাঁর কথায়: “আমরা নিচু জাত বলে প্রায়ই কটাক্ষ শুনতে হত চৌহানদের কাছ থেকে। চৌহানরা ছাড়াও বাদোরিয়া, তোমরদের মতো উঁচু জাতের লোকেরাও আমাদের গালাগাল করত। বিজেপি চুপ ছিল। ভাইয়ের মৃত্যুর পরেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। এখন জামিনে মুক্ত চৌহান। এখানে সব সময়ই রাজপরিবার, উঁচু জাতের প্রভাব। দলিতদের কথা কেউ শোনে না। বিজেপি বড় লোকেদের পার্টি।”
আরও পড়ুন: ‘গুজরাত দাঙ্গার পর মোদীকে বরখাস্ত করতে গিয়েছিলেন বাজপেয়ী, আটকেছিলেন আডবাণী’
সে দিন শুধু গ্বালিয়রেই নয়, ভিণ্ড, মোরেনা, লাঘাট, সাতনা, সাগরেও একই ঘটনা ঘটেছিল। বেশ কয়েক জন যুবকের মৃত্যুও হয়। বিক্ষোভ মিছিল আটকাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন বন্ধ সমর্থকরা। এর পর থেকেই বিজেপি বিরোধী হাওয়া বইছে গ্বালিয়র জুড়ে।
২০০৭ সাল থেকে গ্বালিয়রের কেল্লা বিজেপির দখলে। ফের এক বার সিন্ধিয়া পরিবার স্বপ্ন দেখছে এই আসনটা কংগ্রেসের দখলে নেওয়ার। বিজেপি প্রার্থী বিবেক সেজওয়ালকারের প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের অশোক সিংহ হলেও, দলিতদের ভোটকে মাথায় রেখে এখানে বকলমে লড়ছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াই। কেন্দ্রে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় আসতে হলে, মধ্যপ্রদেশ থেকে বেশি সংখ্যক আসন যে বার করতে হবে, তা ভালই জানে রাজপরিবারের ‘মহারাজ’ জ্যোতিরাদিত্য।