ভাল পোশাক শুধু এটাই। ঝুপড়িতে শ্রমিকের ছেলে। নিজস্ব চিত্র
দিল্লিতে ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র থেকে দূরত্ব ঢিলছোড়া। গুগ্ল বলছে, মথুরা রোড বেয়ে ১৪ কিলোমিটারেরও কম।
কী আশ্চর্য! ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র সিংহের গর্জন তবু শুনতে পায়নি ওখলা! বছরে যে দু’কোটি চাকরি হওয়ার ‘কথা ছিল’, তার প্রায় একটিও চোখে দেখেনি এই তল্লাট। বরং পাততাড়ি গোটাতে দেখেছে বেশ কিছু ছোট কারখানাকে। দিনভর চক্কর কাটার সময়ে যাঁদের সঙ্গে কথা হল, তাঁদের অধিকাংশেরই হয় হাতে কাজ নেই, নইলে কোনওক্রমে টিকে থাকা চাকরির বেতনে সংসার চালাতে প্রাণান্ত দশা। গাড়ির শোরুমে ‘চৌকিদারে’র কাজ করা অভিষেক কুমার বলছিলেন, ‘‘চাকরি কোথায়? মাস গেলে ১০ হাজার টাকা বেতন পাই। তাতেই কারখানার কর্মীরা হিংসে করে রীতিমতো!’’ তাঁর দাবি, তিন বছরে বেতন এক পয়সাও বাড়েনি। কারণ, চাকরির বাজারের যা হাল, তাতে এর থেকে কমে কাজ করতে রাজি অনেকে।
‘হিংসে’ কেন, তা অবশ্য টের পাওয়া গেল কারখানার কর্মীদের সঙ্গে কথা এগোতেই। দুর্গা প্রসাদ বলছিলেন, ‘‘শুধু এক বার আমাদের ঘরে উঁকি দিন। বুঝতে পারবেন, কী ভাবে থাকি। এখানে বহু কর্মী মাসে ৬,০০০-৬,৫০০ টাকা বেতনে কাজ করেন। অথচ ঝুপড়িতে ৮ বাই ৮ ফুটের ঘরে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতেও মাসে লাগে হাজার দুয়েক টাকা। ফলে পরিবার ‘দেশে’ই পড়ে থাকে। এখানে ওই রকম একটি ঘর একসঙ্গে ভাড়া নেন ৪-৫ জন। রাত্রে এক জন নাক ডাকলে বাকিদের ঘুমানোর জো নেই। এমনকি, বাথরুমে যাওয়ার জন্যও দরজা খুলতে হয় বহু কসরত করে।’’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির অর্থনীতির অধ্যাপক পিনাকী চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সংস্থার উৎপাদন খরচ কমানোর জেরে যাতে কর্মীরা অমানবিক পরিবেশে থাকতে বা কাজ করতে বাধ্য না হন, তা খেয়াল রাখা জরুরি। এটি নিশ্চিত করা সংস্থার কর্তব্য। সরকারেরও দায়বদ্ধতা। এই কারণেই সঠিক শ্রম নিয়ন্ত্রণ জরুরি।’’
কিন্তু সরকার তো ন্যূনতম বেতন বেঁধে দিয়েছে! আর বেতনের টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার নিয়ম?
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
মুচকি হেসে কারখানার এক কর্মী হরে রামের জবাব, ‘‘নিয়ম ১০০টা থাকলে, তা ভাঙার রাস্তা ১০১টা। কোথাও ১৪ হাজারের পাশে সই করে হাতে পাওয়া যায় অর্ধেক টাকা। আবার কোনও সংস্থায় সমস্ত কর্মীর এটিএম কার্ড থাকে মালিকের জিম্মায়! ফলে মাসের শুরুতে অ্যাকাউন্টে নিয়ম মেনে ১২-১৪ হাজার টাকা জমা পড়ে ঠিকই। কিন্তু আখেরে কর্মী হাতে পান সেই ছ’হাজারই!’’
ওখলা শিল্প তালুকের ইউনিয়ন নেতা মৃগাঙ্ক বলছিলেন, ‘‘ন্যূনতম বেতনের বাধ্যবাধকতা থাকবে কী ভাবে? ৭০-৭৫ শতাংশ কর্মীর তো খাতায়-কলমে প্রমাণই নেই যে, তাঁরা এখানে কাজ করেন। পিএফ, ইএসআইয়ের দাবি তুললে সটান বার করে দেওয়া হয়। কিন্তু বেকারত্বের সমস্যা এত তীব্র যে, এই কাজের জন্যও হাপিত্যেশ করে আছেন অনেকে। পাশ করেও চাকরি নেই। মাসে ছ’হাজারই সই। এই অবস্থায় মুখ বুজে সব সহ্য করতে বাধ্য
হচ্ছেন কর্মীরা।’’
এমনকি, স্থানীয় কারখানার আর এক কর্মী মনোজ সিংহের অভিযোগ, ‘‘সরকারি অফিসার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এলে, আগে থেকে কর্তৃপক্ষের ঘরে খবর থাকে। ঠিকা কর্মীদের বড় অংশকে কারখানার বাইরে বার করে দেওয়া হয়। যাঁরা অফিসারদের সামনে বয়ান দেন, আগে থেকে শিখিয়ে রাখা হয় তাঁদের।’’
নোটবন্দি আর তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর ধাক্কাতেই কি আরও খারাপ হয়েছে অবস্থা?
অন্তত জনা দশেক কর্মী বললেন, ‘‘নোটবন্দির পরের কয়েক দিন খারাপ কাটেনি। অনেক জায়গায় ৪-৫ মাসের বেতন আগাম দিয়েছিল। তা-ও নগদে। তার উপরে রোজ ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের অ্যাকাউন্টে মালিকের টাকা জমা দিলেই বেতন মিলত। কারখানামুখো না হয়েই। সঙ্গে ওই টাকা কিছু দিন অ্যাকাউন্টে রেখে পরে ফিরিয়ে দিলে কমিশনের হাতছানি।’’ তাঁদের কথায়, ছবি বদলাতে শুরু করল কিছু দিন পর থেকে। আবাসনের মতো যে সমস্ত ক্ষেত্র নগদে টাকা মেটাতে অভ্যস্ত, তাদের অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল রাতারাতি। ভিন্ রাজ্যের অনেক কর্মী সেই যে ‘ঘরে ফিরলেন’, আর এলেন না। ঝাঁপ বন্ধ হল এই এলাকার বেশ কিছু ছোট-মাঝারি শিল্পের।
স্থানীয়রাও বলছেন, ছোট শিল্পের বড় অংশ পরেও সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে বড় সংস্থা জলের দরে ছোট সংস্থাকে কিনে নিয়েছে। অনেক সময় খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ ধরেছে তারা। আবার অনেক ক্ষেত্রে তার পাশাপাশি বাছা হয়েছে বেতন কমানোর রাস্তা। কাজের বাজার খারাপ বুঝে মুখে কুলুপ কর্মীদেরও। এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি কারখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও দেখা মেলেনি। সটান ফিরিয়ে দিয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়নসের প্রেসিডেন্ট অনিমেষ দাসের দাবি, নোটবন্দি যেমন আচমকা ধাক্কা দিয়েছিল, তেমনই ধীরে ধীরে চাকরির বাজারে থাবা বসিয়েছে তড়িঘড়ি জিএসটি চালুও। তাঁর অভিযোগ, ‘‘এতে কাঁচামালের খরচ বেড়েছে। যা সামাল দিতে কর্মী বা নিদেন পক্ষে বেতন ছাঁটাইয়ের রাস্তায় হেঁটেছে বহু ছোট-মাঝারি সংস্থা।’’ তাঁর দাবি, এই জোড়া ধাক্কায় শুধু ওখলাতেই কর্মী কমে গিয়েছে ১০-১৫ শতাংশ। ভোটের মুখে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য যে পেনশনের কথা কেন্দ্র বলেছে, তা নিয়েও কর্মীদের প্রশ্ন, ‘‘কাজেরই নিশ্চয়তা নেই। ৬০ বছর পর্যন্ত ফি মাসে টাকা দেব কোথা থেকে?’’
এলাকায় ঘুরতে ঘুরতেই পরিচয় হয়েছিল এক দেহাতি প্রৌঢ়ার সঙ্গে। তাঁর ছোট্ট দোকানে চা খেতে আসেন কারখানার কর্মীরা। বলছিলেন, ‘‘ইন্দিরা গাঁধী মারা যাওয়ার বছরে বিয়ে হয়ে দিল্লি এসেছিলাম। গত বার বড় ভরসা করে ভোট দিয়েছিলাম মোদীকে। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী অনেক কাজ করেন। কিন্তু এখানে তো দেখছি কারখানা, কর্মী কমে যাচ্ছে। দোকানে খদ্দেরও।’’
তা হলে? ওখলায় ভাল নেই চৌকিদার। হাল খারাপ চা বিক্রেতারও। আর বাকিরা? সারা দেশে?
(চলবে)