ভয় ভিতরে, ভয় বাইরে

‘কাশ্মীর কি কলি’র কোরিয়োগ্রাফির অতীতকথা নয়। ডাল লেক বলছে, বহু ঝড়ঝাপটা সামলে এই সে-দিন পর্যন্তও কাশ্মীরের আম-আদমির পেটে এত টান পড়েনি।

Advertisement

অগ্নি রায়

শ্রীনগর শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫৫
Share:

বিষণ্ণ: শিকারা-চালক ফিরদৌস আজাদ। নিজস্ব চিত্র

পসরা বোঝাই ছোট ছোট নৌকা মখমল সজ্জিত শিকারার পাশের তক্তায় মৃদু ধাক্কা মারছে। এখানকার জলবাণিজ্যের রেওয়াজ-মাফিক এই ঠোকাঠুকিতে যে শব্দ তৈরি হচ্ছে, তাকে আজ শোনাচ্ছে বিষণ্ণ এক চিয়ার্স-ধ্বনির মতন!

Advertisement

অথচ এটাই ‘উল্লাস’ তৈরি করত পর্যটনমুখর সুদিনে। ‘কাশ্মীর কি কলি’র কোরিয়োগ্রাফির অতীতকথা নয়। ডাল লেক বলছে, বহু ঝড়ঝাপটা সামলে এই সে-দিন পর্যন্তও কাশ্মীরের আম-আদমির পেটে এত টান পড়েনি।

“পুলওয়ামার পরে ইন্ডিয়ান ফোর্স কত জনকে ও-দিকে খতম করেছে জানি না। কিন্তু আমাদের পেটে লাথি মেরে দিয়েছে। গত এক মাসের সমস্ত হাউসবুক হোটেলে অনলাইন বুকিং ক্যানসেল হয়ে গিয়েছে। ভয়ের পরিবেশ। ট্রাভেল এজেন্টদেরও নাকি বলে দেওয়া হয়েছে কোনও বুকিং না নিতে”, বৈঠা চালাতে চালাতে বলছেন ফিরদৌস আজাদ।

Advertisement

ভয় ভিতরে, ভয় বাইরে। চিনার গাছে ঘেরা ডাল লেকের গভীরে চলে এসেছি কথায় কথায়। আশপাশ থেকে ছোট নৌকা আসছে দিনভর রোজগারহীনতার ক্লান্তি আর আখরোট, কেশর, রঙিন পাথরখচিত গয়নার পসরা সাজিয়ে। দূরে সুনসান বাহারি নামের হাউসবোটগুলি দাঁড়িয়ে ভুতুড়ে ছবির সেটের মতন। বাদামের গুঁড়ো, এলাচ আর কেশর দিয়ে বানানো এখানকার জনপ্রিয় কাওয়া চায়ের কেটলি-বাহী নৌকা নিয়ে জল কেটে এগিয়ে এলেন গুলাম আহমেদ। তাঁর মুখের জ্যামিতি বলে দিচ্ছে, ভূস্বর্গের বহু সুখদুঃখ ভিতরে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। “বহু ভাগ্য করে তিন তিন বার বরফ পড়েছিল কাশ্মীরে। ভাবলাম, আল্লাতালার দুয়া। গোটা বছরের কামাই হয়ে যাবে। বালবাচ্চা খেতে পাবে। সব নষ্ট হয়ে গেল।”

শুনতে শুনতে জুড়িয়ে যাচ্ছে হাতে ধরা কাওয়া চা। ভোটের মুখে দাঁড়ানো ভারতকে দেখতে বেরিয়ে, প্রথমেই এসেছি কাশ্মীরে। জানাই ছিল, উপত্যকার মন ভাল নেই। কিন্তু এমন সর্বগ্রাসী ভয় আর বিষাদ, গত পনেরো বছরে কর্মসূত্রে বহু বার এসে কাশ্মীরে দেখেছি কি না, চট করে মনে পড়ছে না। এ যেন এক আতঙ্কের ত্রিভুজ। যার একটি বাহু পুলওয়ামা পরবর্তী গোটা দেশে কাশ্মীরি ছাত্রদের উপর অত্যাচারকে ঘিরে। দুই, সংবিধানের ধারা তথা রাজ্যের জন্য বিশেষ আইন অবলুপ্ত করে এখানকার জনচরিত্র বদলে দেওয়ার চেষ্টায়। তিন, ভোটের মধ্যে বা ঠিক আগে ফের সীমান্তে বড় ধরনের যুদ্ধবাজি তৈরি হওয়ায়।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

রিগ্যাল চকের কাছে বছর দশেক হল তৈরি হয়েছে আধুনিক বই বিপণি। ভাল লাগল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দুপুর বেলায় বইয়ের তাকে হুমড়ি খেয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু তাদের চোখ এতটাই সন্ত্রস্ত যা ওই বয়সে হওয়ার কথা নয়। ‘‘ছবি তুলবেন না প্লিজ।
এমনিতেই বাবা-মায়ের ঘুম উড়ে গিয়েছে দিল্লিতে পড়তে যাব বলে।” নরম গলায় জানাচ্ছেন আয়াথ মাসুদ। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সঙ্গে বান্ধবী আয়মন আইজগ। দুজনেই চান মনস্তত্ত্ববিদ হতে। “আমাদের সিনিয়রেরা বাইরের রাজ্যগুলিতে কী ভাবে মার খাচ্ছে, খবর তো পাই। আমরা ভারত-বিরোধী নই এই কথাটাও জোর দিয়ে বলতে পারার সুযোগ নেই, কারণ কথা বলার স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।” এ আর আশ্চর্যের কী যে এই দোকানে সব চেয়ে বেশি বিক্রি হয় ‘কনফ্লিক্ট’ বিষয়ক (জানাচ্ছেন মালিক মনজুর উল হক) বই।

শ্রীনগরে আসার পরই দীর্ঘ কথা হয়েছে শাহ ফয়জলের সঙ্গে। আইএএস টপার ফয়জল নিয়ন্ত্রণের দমবন্ধ পরিবেশে টিকতে না পেরে ইস্তফা দিয়ে গড়েছেন ‘জম্মু কাশ্মীর পিপলস মুভমেন্ট’। মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এই সংগঠন তথা দল এখানকার রাজনৈতিক পরিসর দখলের চেষ্টায় এগিয়েছে। ফয়জল বলছেন, “পুলওয়ামার পরে এমন ঘৃণা গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে আমরা অত্যন্ত শঙ্কিত। এক ধাক্কায় অনেক বছর পিছিয়ে গেল উপত্যকা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, মানবাধিকার সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হুরিয়তদের সঙ্গে আলোচনার সেতু। এরকম নির্লজ্জ ভাবে গোটা দেশের ভোট ব্যাঙ্ক রাজনীতির খাতিরে কাশ্মীরকে ব্যবহার করা হয়নি আগে।”

আর পিডিপি-র যুব সভাপতি ওয়াহিদ ফারা তীব্র হতাশায় বলছেন, “আমাদের মতো মূল ধারার রাজনৈতিক দলের পরিসর কমছে। কাশ্মীরের গ্রামে সেই জায়গা দখল করছে জঙ্গিবাদ। অন্যদিকে, গোটা দেশে জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে নিরাপরাধ কাশ্মীরিদের কড়কাচ্ছে বিজেপি সরকার। প্রত্যেকটি কাশ্মীরি ছাত্রই না একসময় মানব বোমা হয়ে যায়! নিজেদের ভোট ব্যাঙ্কের জন্য দেশকে বড় ঝুঁকির সামনে ফেলল শাসক দল।”

সূর্য, ডাল লেকের সঙ্গে শেষ খেলা সেরে পাটে উঠছে। ঠান্ডাও যেন বেড়ে গেল আরও একটু। ফিরদৌস শিকারা নোঙর করে বিড়ি ধরানোর তোড়জোড় করছেন। রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। জম্মুর জন্য রওনা হতে হবে। শ্রীনগরকে পিছনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, সৌন্দর্যের মতন এই উপত্যকার মনখারাপটাও বোধহয় সংক্রামিত হয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement