অর্ধেক দিন কাজ থাকে না। শুধুই অপেক্ষা তিরুপুরের রাস্তায়। নিজস্ব চিত্র
গেঞ্জি কারখানার চাকরিটা গিয়েছিল আচমকা। নোটবন্দির পরেই। বাড়ি ফিরে ২৩ বছরের ছেলেটা দেখেছিল, অসুস্থ ছোট বোনকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলছে। মা জানিয়েছিলেন, শুধু বোনের চিকিৎসাই নয়, সব কিছুর জন্যই তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে গোটা পরিবার। ছেলেটা চাকরি খোয়ানোর কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি। দু’ সপ্তাহের মধ্যেই ফেরত এসেছিল তিরুপুরে। আর বাড়ি ফেরেনি।
এখনও কোনও চাকরি নেই। তার সঙ্গে চাকরি করত, এমন অনেকেই কাজ হারিয়ে যে যার জায়গায় ফিরে গিয়েছে। যখন যে কারখানায় দরকার পড়ে, ছেলেটা এখন সেখানে খুচরো কাজ করে। যেটুকু টাকা জোটে, বাড়িতে পাঠায়। নিজে এঁর-তাঁর বাড়ি, কখনও রাস্তাতেও রাত কাটায়। রোজ দু’বেলা ভরপেট খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কথা বলতে বলতে বারবার চোখের জল মুছছিলেন ওই যুবক। সাংবাদিকের দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘‘দেখবেন, আমার বাবা-মা যেন জানতে না পারে।’’
তিরুপুরের কাদেরপেট এলাকায় অনেকেই জানেন বঙ্গের একটি জেলা-শহরের এই যুবকের কথা। স্থানীয় কারখানার কর্মী হাবিবুল বললেন, ‘‘ওকে তো ভিক্ষাও করতে হয়েছে অনেক সময়ে। ও বলে, যে করে হোক বাড়িতে টাকা পাঠাতেই হবে। চাকরি যাওয়ার কথা জানলে ওর বাবা-মা বাঁচবেন না। ওর মতো এত খারাপ না হলেও আমাদের অনেকেরই অবস্থা কমবেশি একই রকম।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বাইরে থেকে আচমকা দেখলে কিছুটা আঁচ করা যায়। আর ভিতরে তো একেবার ধ্বস্ত, নুইয়ে পড়া চেহারা তিরুপুরের।
অথচ তামিলনাড়ুর এই তিরুপুর হল দেশের সবচেয়ে বড় বস্ত্রশিল্প কেন্দ্র— ‘টেক্সটাইল হাব’। বিদেশে রফতানি হওয়া ভারতীয় বস্ত্রের প্রায় ৯০ শতাংশই যায় এখান থেকে। প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের রুটিরুজির সংস্থান করেছে এই শিল্প।
করেছে, নাকি করেছিল?
তিরুপুরে ঘুরলে মনে হয়, অতীতের কঙ্কাল আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে এই শহর। বেসরকারি হিসাব বলে, নোটবন্দির পরে দু’ বছরে দেড় লাখেরও বেশি মানুষের চাকরি গিয়েছে। অভাবের জ্বালায় আত্মহত্যা, বিয়ে ভেঙে যাওয়া, সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অজস্র ঘটনা প্রতিনিয়ত তাড়া করছে এখানকার মানুষদের। ‘মৃত্যুশয্যা’ থেকে দু’ বছর পরে কোনও মতে উঠে দাঁড়ালেও সারা শরীরে এখনও দুরারোগ্য রোগের বাসা।
কথা হচ্ছিল রাজারহাটের ইয়াসিন গাজির সঙ্গে। এক সময়ে এখানে একটি ছোট টেক্সটাইল ইউনিটের মালিক ছিলেন। তাঁর অধীনে কাজ করতেন ২০ জন। এখন তিনিই কাজ করেন অন্যের অধীনে। দু’বছর আগে কাজ খুইয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। আট মাস আগে আবার এসেছেন। তাঁর সন্তানের বয়স এখন সাত মাস। বললেন, ‘‘ছেলেটার মুখ দেখিনি। বাড়ি ফিরতে ভয় করে। যদি ফিরে এসে দেখি, এই কাজটুকুও নেই।’’
কাদেরপেট, শহিদ কলোনি, অবিনাশী রোড, তিরুপুর পুরনো বাসস্ট্যান্ডের ধার ঘেঁষে তৈরি হওয়া অজস্র ইউনিট দিনভর চষে ফেলে শুধু এই আতঙ্কের কথাই শোনা গিয়েছে। তিরুপুর এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তার কথায়, ‘‘সবাই বলেন, দু’ বছর তো হল। এখনও এত খারাপ অবস্থা! আমরা কী করে বোঝাব, যে মরণকামড় দেওয়া হয়েছে তা থেকে মুক্তি এত সহজ নয়। শুধু শ্রমিকরা নয়, আমরাও মরছি।'’
সিটুর তামিলনাড়ুর রাজ্য সহ-সভাপতি এম চন্দ্রন বলছিলেন, ‘‘আমরা যতটুকু জানি , বিদেশে রফতানি এখন কিছুটা হচ্ছে। কিন্তু কর্মীর অভাবে সময়ে অর্ডার সরবরাহ না হওয়ায় অর্ডার বাতিলও হচ্ছে। আর ডোমেস্টিক ইন্ডাস্ট্রি তো পুরো ডাউন।’’ চন্দ্রন শোনাচ্ছিলেন গত বছরের একটি ঘটনার কথা।এক শ্রমিকের আট মাস বাড়িভাড়া বাকি পড়েছিল। ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতেন। স্কুলের ফি বাকি। বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বার করে দেয়। ছেলেকে তাড়িয়ে দেয় স্কুল। সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিলেন ওই শ্রমিক। এআইটিইউসি-র বানিয়ান ফ্যাক্টরি লেবার ইউনিয়নের নেতারাও শুনিয়েছেন এমন নানা হতাশার কাহিনি। তিরুপুরের ছোটবড় বিভিন্ন বস্ত্র সংস্থার মালিকদের বক্তব্য, ‘‘আমরাই বা কী করব? দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক মজুরি দেওয়া হয় কর্মীদের। বেশিরভাগটাই নগদে। নোটবন্দির পরে আমাদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল। যাঁর কারখানায় দু’শো কর্মী কাজ করতেন, তিনি হয়তো মাত্র পঞ্চাশ জনকে রাখতে পেরেছেন।’’
এক কারখানা মালিকের কথায়, ‘‘মাসের পর মাস টাকা দিতে পারতাম না। কাউকে কাউকে শুধু হাত খরচটাই দিতাম। তাই অনেকে নিজেরাই ছেড়ে দিয়েছেন।’’
নোটবন্দি তিরুপুরে মালিক-শ্রমিক দু’পক্ষকেই রাস্তায় এনে ফেলেছে। নোটবন্দির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা উগরে দিয়েছেন ক্ষোভ। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। যা চলছে তার অনেকটাই অপপ্রচার।
সত্যিই তাই?
কাদেরপেটের মুখে লস্যির দোকানের মালিক বললেন, ‘‘আগে এখানে চারটি দোকান ছিল। এখন কারখানা বন্ধ। তাই লস্যি খাওয়ার লোক নেই। চারটের জায়গায় একটা দোকান। শুধু কাপড়ের কারখানা নয়, আমাদের পেটেও টান পড়েছে। মোদীকে বলুন, অনেক হয়েছে। নতুন করে কাজ না দিলেও চলবে। যাঁদের কাজ আছে, তাঁদের যেন আর বেকার না করেন।’