মন্দসৌরে ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা। —নিজস্ব চিত্র।
মন্দসৌরের পিপলিয়া মান্ডি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, ‘হারভেস্টার’ নামক এক অতিকায় যন্ত্র যেন নিমেষের মধ্যে গিলে খাচ্ছে গমের খেতগুলি। মধ্যপ্রদেশে এখন আর কাস্তে হাতে কৃষক প্রায় দেখাই যায় না। একরের পর একর জমিতে ফসল তুলছে হারভেস্টার।
রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে ফসল তোলার এই মহাযজ্ঞকিছুক্ষণ দেখলাম। তার পর ফের পিপলিয়া মান্ডির দিকে গড়াল গাড়ির চাকা। ন্যায্য মূল্যের দাবিতে মন্দসৌর থেকেই কৃষক আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল গোটা মধ্যপ্রদেশে।ঢেউয়ের ঝাপটা সামলাতে পারেননি শিবরাজ সিংহ চৌহান। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র গদি উল্টে যায়। ঋণমকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস।
মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ কি চাষিদের ভাগ্য বদলাতে পেরেছেন? মনের মধ্যে এ সব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল। কখন যে পৌঁছে গেলাম বড়খেড়া পন্থে… মালুমই হল না।রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকানে জটলা দেখে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম। খেত থেকে সবে এসেছেন ওঁরা। আলাপচারিতার শুরুতেই হাতে চায়ের গ্লাস ধরিয়ে এক ব্যক্তি বললেন, “আমি বড়খেড়া পন্থেরপঞ্চায়েত প্রধান দীনেশ কার্পেন্টার। কংগ্রেস কর্মী। তা-ও বলছি এখনও অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি।”
আরও পড়ুন: শিখ দাঙ্গা নিয়ে স্যাম পিত্রোদার মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করলেন অমিত শাহ
এমন সময় হাজির অভিষেক পাটিদারের দাদা মধুসূদনও। মন্দসৌরের কৃষক আন্দোলের সময় পুলিশের দু’টি গুলি অভিষেকের বুক এবং পেট এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছিল। মৃত্যু হয় আরও পাঁচজনের। ভাইয়ের মৃত্যু এখনও ভুলতে পারেননি বছর তিরিশের এই যুবক। হিন্দিতে মধূসুদন বললেন, “আমাদের কিছু হবে না।”প্রশ্ন করলাম, কেন? সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল, “এত আন্দোলন। নেতাদের ভাষণ। এত কিছুর পরেও চাষিরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে কোথায়? আমারই ঋণ মাফ হয়নি। মন্দসৌরে কিছুই বদলায়নি।ঋণের বোঝা নিয়ে মাত্র ২ টাকায় পেঁয়াজ বেচতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। ক্ষতিপূরণ বাঋণ মকুব সমাধান নয়। ব্যবসা বা চাষ করতে নামলে ঝুঁকি থাকেই। যদি মান্ডি ন্যায্য মূল্যে ফসল কিনত, তাহলে আমাদের আর ঋণই নিতে হত না।”
মধূসুদনের কথা শুনে দক্ষিণ দিনাজপুরের চাষিদের কথা মনে পড়ে গেল। সেখানেও তো একই সমস্যা। কৃষকদের ভাগ্য যেন বদলায় না! তাই মন্দসৌর বা দিনাজপুর কোথাও যেন এক হয়ে যায়।
চায়ের দোকানের পাশেই মধুসূদনের বাড়ি। খটিয়ায় শুয়ে রয়েছেন এক প্রৌঢ়। মধুসূদন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন,“দাদা (ঠাকুরদা) এখানেই শুয়ে থাকেন। ওঁর জমি আমাকেই দেখতে হয়। বাবা-ভাইয়ের মৃত্যুর জন্যে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে আলাদা থাকেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’’
আরও পড়ুন: গেরুয়া চোরাস্রাতের মাঝে আচমকা চাঙ্গা বামও, চওড়া হাসছেন ‘বাঁকুড়ার ভগীরথ’
কৃষক মান্ডির সামনে গমভর্তি ট্রাক্টর। —নিজস্ব চিত্র।
এ বছরই পেঁয়াজ চাষ করেছেন মধুসূদন। কিন্তু মান্ডিতে পেঁয়াজের দাম নেই। ১ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ২ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ১ কুইন্ট্যালের দাম মাত্র ২০০ টাকা!
তত ক্ষণে মধুসূদনের বাড়িতে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। হাজির কোচরুলাল চারওয়াবত, লক্ষ্মীনারায়ণ কার্পেন্টাররা।কৃষক আন্দোলনে প্রথম থেকেই ছিলেন ওঁরা। কোচরুলাল নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন, “১০ দিন নয়, প্রায় ৪ মাস হতে গেল। এখনও সিংহভাগ কৃষকের ঋণ মাফ হয়নি। নানা রকম নিয়ম দেখাচ্ছে। ভোটের আগে এত কিছু বলেনি কংগ্রেস। এখন সরকার বলছে, ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত যাঁরা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ছিলেন, তাঁদের নাম তালিকায় আগে উঠবে। তার পর একে একে বাকিদের। তা-ও আবার লোকসভা ভোটের পর। বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা এই সুবিধা পাবে না।”
কোচরুলাল নিজে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই প্রসঙ্গ উঠলেই, রাহুল গাঁধীর নাম টেনে আওড়াতে থাকেন, যাঁদের দু’লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যাঙ্কে ঋণ রয়েছে, ক্ষমতায় এলে ১০ দিনের মধ্যে তা মকুব হয়ে যাবে। কী প্রতিশ্রুতি!
আরও পড়ুন: ‘ছত্রধরও তো এখন করে খাওয়ার দলে’, লাল ঝান্ডাই আশা জোগাচ্ছে জোড়াফুল শিবিরে
লক্ষ্মীনারায়ণ দিনমজুর খাটেন কোচরুলালের জমিতেই। তাঁর কথায়, “মন্দসৌরের কৃষকেরা আন্দোলন করছিলেন ন্যায্য দামের জন্যে। কৃষক মান্ডিতে সঠিক মূল্যে ধান, গম, চানা, সোয়াবিন, পেঁয়াজের দাম পাওয়া যাচ্ছে কি না, সেটাই বড় ব্যাপার। মালিক যদি ফসলের দাম না পায়, তাহলে আমাদের রোজের দাম দেবে কোথা থেকে। ওই যে হারভেস্টার নামানো হয়, কোথা থেকে উঠবে তার খরচ?”
লোকসভা ভোটের বাজারে শিবরাজ সিংহ চৌহানের গলাতেও একই সুর। প্রচারের ময়দানে কংগ্রেসকে তুলোধোনা করে ‘মামা’ বলছেন, “এই সরকার কৃষকদের দেওয়া কথা রাখেনি। এর জবাব ওরা পাবে।” এ সব বিতর্ক দূরে সরিয়ে জব্বলপুরের একটি জনসভায় কমলনাথের ঘোষণা, “কৃষকদের জন্য আমরা আছি। ঋণমকুব হয়নি এটা ঠিক নয়।লোকসভা ভোটের জন্যে এখন প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। কৃষকদের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি আমার কাছে চ্যালেঞ্জ, যুবকদের কাজের ব্যবস্থা করা।”