প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের লনে আলাপচারিতায় নরেন্দ্র মোদী ও অক্ষয় কুমার। ছবি: টুইটারের ভিডিয়ো থেকে নেওয়া
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তাঁর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই ছিল না! কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবেননি প্রধানমন্ত্রী হবেন। অল্প বয়সেই ছেড়েছিলেন পরিবার। দেশই ছিল তাঁর মা-বাবা। বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমারের সঙ্গে ‘সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক’ কথোপকথনে উঠে এল এমনই এক নরেন্দ্র মোদীর জীবন সংগ্রাম। এমন এক প্রধানমন্ত্রীর চরিত্র, যিনি দেশ ছাড়া কিছু ভাবেন না, গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন, ঘুমোন মাত্র তিন-চার ঘণ্টা। আবার রাজনীতি, প্রধানমন্ত্রিত্বের গাম্ভীর্যের বাইরে হাসিঠাট্টাও করেন। যেমন করলেন ‘খিলাড়ি’ অক্ষয় কুমারের সঙ্গে। অর্থাৎ, তিনিও যে আম জনতার মধ্যে থেকেই উঠে আসা ‘কমন ম্যান’, সেটাই বোঝালেন প্রধানমন্ত্রী। সামান্য ‘চায়েওয়ালা’ থেকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পিছনের যে সংগ্রামের কাহিনী প্রচলিত ছিল বা তথ্যভাণ্ডারে ছিল, সেটা যেন পূর্ণতা পেল তাঁর নিজের কথাতেই। রাজনীতির বাইরেও তৈরি হয়ে গেল ব্যক্তি ‘ব্র্যান্ড মোদী’। যদিও এটা যে পুরোপুরি ‘রাজনীতি বর্জিত’, এটা হলফ করে বলতে পারছেন না পর্যবেক্ষকরা।
মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের তৃতীয় দফার পর অক্ষয় কুমারের টুইটার ঘিরে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। সিনেমার টিজারের ঢঙে যে ভাবে ‘সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক’ কথপোকথন বলে সাক্ষাৎকারের ছোট ছোট যে ক্লিপিংস টুইটারে ছেড়েছিলেন অক্ষয়, তাতে মেজাজটা বোঝা গিয়েছিল। তার উপর ছিল বলিউডি উপস্থাপনার কৌশল। প্রধানমন্ত্রীর ৭ লোককল্যাণ মার্গের বাড়ির বারান্দায় বসে কখনও দু’জনের আড্ডা জমে উঠেছে। অক্ষয় কুমারের অনুরোধে আবার লনে হাঁটতে হাঁটতেও কথা হয়েছে দু’জনের। পরতে পরতে ফিল্মি ড্রামা, ক্লাইম্যাক্স, অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স না থাকলেও এ যেন এক ‘রিয়েলিটি শো’। প্রথাগত ওজনদার তুখোড় রাজনৈতিক কুটকচালির বাইরে খোশমেজাজে গল্পের ছলে দুই জগতের দুই অন্যতম সেরার এই যুগলবন্দি দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল দেশ।
বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবেন, ভেবেছিলেন? মোদীকে প্রশ্নটা করেই ফেললেন করলেন অক্ষয়। জবাব এল, ‘‘আমি কখনও ভাবিনি প্রধানমন্ত্রী হব। সাধারণ মানুষ কখনও সেটা ভাবেও না। যে ধরনের পরিবার থেকে উঠে এসেছি, তাতে আমি একটা সরকারি চাকরি পেলেই আমার মা হয়তো লাড্ডু বিলি করে বেড়াতেন।’’
পরিবার এবং তাঁর নিজের অবস্থা বোঝাতে নিজেই উল্লেখ করেন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রসঙ্গ। মোদী বলেছেন, ‘‘আমার কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই ছিল না। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন দেনা ব্যাঙ্কের লোকজন এসে একটি পিগি ব্যাঙ্ক দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে তেমন টাকা পয়সা ছিল না। পরে ব্যাঙ্কের লোকজনই এসে বলেন, আমার অ্যাকাউন্টে লেনদেন না হওয়ার জন্য সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ৩২ বছর পর ওরা আমাকে বলেছিল, ছোট বয়স থেকেই আমার একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আমি যখন মুখ্যমন্ত্রী হলাম (গুজরাতের) আমার মাইনে পড়ত ওই অ্যাকাউন্টে। ওঁদের বলেছিলাম, আমি ওই টাকা দান করতে চাই। ওঁরা বলেন, আমার বিরুদ্ধে মামলা আছে, আমার দরকার হতে পারে। কিন্তু আমি তাঁদের জোর করে বলেছিলাম, ২১ লক্ষ টাকা আমি গরিবদের দান করতে চাই।’’
আরও পডু়ন: প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন দিদি, কটাক্ষ মোদীর
আরও পড়ুন: এন ডি তিওয়ারির ছেলে রোহিত-হত্যায় তাঁর স্ত্রীকেই গ্রেফতার করল পুলিশ
আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের মতো তিনি নন। বাড়ি ঘর, সংসার ছেড়েছেন কিশোর বয়সেই। কিন্তু কখনও কি মনে হয় না পরিবারের সঙ্গে, মা, ভাই-বোনের সঙ্গে থাকার কথা? মোদীর জবাব, ‘‘আমি ছিলাম কার্যত পরিব্রাজক। আমি নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছিলাম। যুবক বয়সেই আমি নিজের পথে চলেছি। সেটার থেকেই জন্ম হয়েছে একটা বিচ্ছিন্নতার। পরে যখন আমি মাকে বলেছি আমার সঙ্গে থাকতে, উনি গ্রামেই থাকতে চেয়েছেন। উল্টো দিকে আমি নিজেও মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পাইনি।’’
অর্থাৎ কার্যত সন্ন্যাস নিয়েছেন। কিন্তু তা বলেন মানুষের সহজাত অনুভুতিগুলো-আবেগগুলোও কি মরে গিয়েছে? কখনও কি রাগ হয় না, হলে কী করেন? প্রশ্ন শুনেই মোদী বললেন, আমি খুব সহজে রাগ করি না। যদিও এটা মানুষের চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট। এটা এমন একটা আবেগ, যা নেগেটিভিটি ছড়ায়। যখন কেরিয়ার (রাজনৈতিক) শুরু করি, তখন থেকে কখনও রাগ প্রকাশ করিনি।’’ আরও একটি গোপন কথা ফাঁস করেছেন মোদী। জানিয়েছেন, রাগ বা অন্য কোনও অনুভুতির আতিশয্য হলেই সেটা তিনি লিখে রাখেন। তার পর সেটা নিয়ে ভাবতে থাকেন। ‘‘এটা আমার নিজের ভুল বুঝতে সাহায্য করে। তবে হ্যাঁ, ওটার পিছনে বেশি সময় দিই না। যে কোনও পরিস্থিতিতে এই ভাবেই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মতো আমি নিজেকে তৈরি করে ফেলেছি।’’ — বলছেন মোদী। এই ফাঁকে রাগ হলে তিনি নিজে কী করেন, সেটাও জানিয়ে রাখলেন অক্ষয়। বললেন, ‘‘আমার বাড়িতে একটা বক্সিং ব্যাগ আছে। রাগ না কমা পর্যন্ত ওই ব্যাগে প্রচুর ঘুসি মারতে থাকি।’’
আরও পডু়ন: গির্জায় হামলা হতে পারে, বিস্ফোরণের দু’ঘণ্টা আগেই শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিল ভারত
সংসারত্যাগের ক্ষেত্রে আম জনতার অনেকের থেকেই আলাদা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা এখনকার সময়ে যে অসম্ভব, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মোদীও পারেন না। অক্ষয়কে বললেন, ‘‘টুইটার ফেসবুক পোস্টে যে সব মজা হয়, আমি সেগুলো উপভোগ করি। তবে ওগুলোর মধ্যে মোদীকে দেখি না। সৃজনশীলতা দেখি। আমি মনে করি, সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এখান থেকেই আমি দেশের মানুষের মনোভাব বুঝতে পারি।’’
এর মধ্যে অবশ্য এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মিষ্টি ও উপহার পাঠানোর কথা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদের সঙ্গে সখ্যতার গল্পও। আবার অক্ষয়ের প্রশ্নে দিনে-রাতে মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমানোর প্রসঙ্গেও মোদী টেনে এনেছেন বারাক ওবামার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ। বলেছেন, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করেন, এখন ঘুম বাড়িয়েছেন?’’
রাজনীতি তাঁর রক্তে। প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি বাক্যে রাজনীতির ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু অক্ষয় কুমারের সঙ্গে তাঁর এই বাক্যালাপ ছিল ‘রাজনীতি বর্জিত’। কিন্তু সত্যিই কি তাই? পর্যবেক্ষকদের সিংহভাগই বলছেন, প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতির কোনও কথা না থাকলেও সুকৌশলে সেটা ঢুকে পড়েছেই। হয়তো সচেতন ভাবে। নয়তো অবচেতনেই। কীভাবে?
দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন অক্ষয় কুমার। মোদী বক্তব্য, আগের প্রধানমন্ত্রী সাড়ে পাঁচটা-ছ’টায় অফিস ছেড়ে যেতেন। কিন্তু তিনি গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন। কর্মীরাও প্রধানমন্ত্রীর পদের গুরুত্ব বুঝে আগে হালকা কথাবার্তা বলতে ভয় পেতেন বা সংকোচ বোধ করতেন। কিন্তু এখন করেন না। অর্থাৎ আগের প্রধানমন্ত্রীদের তুলনায় তিনি কতটা দক্ষ, দায়িত্বশীল ও পরিশ্রমী— সে সব সুকৌশলে বুঝিতে দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গাঁধী প্রেমের কথা বলতে গিয়ে তুলেছেন স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রসঙ্গও, যা মোদী সরকারের অন্যতম একটি প্রকল্প।