প্রতিদিন দেশে অসংখ্য মেয়ে ধর্ষিত হলেও দৃষ্টান্তমূলক ভাবে দোষীদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর করার ব্যাপারে কারও গা নেই।
শীর্ণ চেহারা। কানে ফোনটা নিয়ে চোখের জলে ভাসছিলেন মহিলা।
স্পিকারে দেওয়া ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে তখন ভেসে আসছে—‘‘কিসি ভি সরকার সে কুছ উম্মিদ মত রখিয়ে। খুদ আপকো আপনা লড়াই লড়না হ্যায় বহন। আপনে আপ পে ভরোসা রখিয়ে। উন লোগোঁকো ছোড় না নেহি। সাজা দিলানা হ্যায়। ম্যায় হুঁ আপকে সাথ।’’
কোনও সরকারের উপরে ভরসা নয়, নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে বলে যিনি এই সাহস দিলেন, তিনি দিল্লির নির্ভয়ার মা। রবিবার সকালে তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে মিনিট পাঁচেক কথা হল কামদুনিতে ধর্ষণের ঘটনায় নিহত তরুণীর মায়ের। প্রত্যুত্তরে কামদুনির মা শুধু বলতে পারলেন, ‘‘আপনার মেয়েও আমার মেয়ে। আপনার ভিতরটা কতটা পুড়ে যাচ্ছে, আমি জানি। কোনও সরকার বুঝতে পারবে না মেয়ের খুনির শাস্তির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হলে মায়ের কী হয়!’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়া দুই ধর্ষণের ঘটনা। দুই তরুণীই মৃত। এক জনের ক্ষেত্রে কেটে গিয়েছে সাত বছর, অন্য জনের ছ’ বছর। দু’ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা ধরা পড়েছে, সাজা ঘোষণাও হয়েছে। কিন্তু সেই সাজা কার্যকর হয়নি এখনও। অভিযোগ, এক সময় বাড়িতে ভিড় করে থাকা রাজনৈতিক নেতারা অদৃশ্য হয়েছেন। দুই মায়ের উপলব্ধি, সরকার যাবে-আসবে। কিন্তু প্রতিদিন দেশে অসংখ্য মেয়ে ধর্ষিত হলেও দৃষ্টান্তমূলক ভাবে দোষীদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর করার ব্যাপারে কারও গা নেই।
ফোনে নির্ভয়ার মায়ের গলা থেকে ফলার মতো বেরোচ্ছিল শব্দগুলো—‘‘নারীর ক্ষমতায়ন, সমানাধিকার, আসন সংরক্ষণ নিয়ে এত কথা। কিন্তু ভোট দেওয়ার পরে মেয়েরা যে সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন, এমন গ্যারান্টি কোনও দল দিতে পারবে? কোনও দল তাদের ইস্তাহারে কি বলেছে যে, ক্ষমতায় এলে মহিলাদের নিরাপত্তা আর ধর্ষণকারীদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা হবে? আসলে কোনও দলের কিচ্ছু যায়-আসে না।’’
দিল্লির কাছে দ্বারকায় দু’কামরার ফ্ল্যাটে মেয়ের ছবি রাখেননি নির্ভয়ার মা। তাঁর নিজের শোয়ার ঘরের দেওয়াল জুড়ে প্রদীপের শিখার ছবি বাঁধিয়ে টাঙানো। মায়ের প্রতিজ্ঞা, দোষীদের শাস্তি কার্যকর হলে তবেই মেয়ের ছবি টাঙিয়ে মালা দেবেন। বলছিলেন, ‘‘এখন তো মনে হয়, বেঁচে থাকতে আর মেয়ের ছবিতে মালা দিতে পারব না। এর পর কারও ইচ্ছে করে ভোট দিতে যেতে? নিজের জীবন দিয়ে দেখলাম, সব এক।’’ তাঁর কথা যেন কামদুনির তরুণীর মায়ের গলাতেও—‘‘আমি আর ওর বাবা খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। মেয়েটা যদি অসুখে ভুগে মরত সেটা একরকম। কয়েকটা রাক্ষস ছিঁড়ে খেল, অথচ এখনও সাজা কার্যকর হল না। জ্বলছে ভিতরটা। যে কোনওদিন মারা যাব। বোধহয় তার আগে সাজা দেখে যেতে পারব না। দিতে চাই না ভোট কাউকে। সব বৃথা।’’
২০১২ সালে ১৬ ডিসেম্বর হয়েছিল নির্ভয়ার ঘটনা। পরের বছর সেপ্টেম্বরে চার অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড হয়। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। গত বছর জুলাইয়ে সাজাপ্রাপ্তদের রিভিউ পিটিশনও অগ্রাহ্য হয়। তবে শাস্তি কার্যকর হয়নি। এই বিলম্বের বিরুদ্ধে নির্ভয়ার পরিবার আবার নিম্ন আদালতে গিয়েছে। গত ২ মার্চ শুনানির তারিখ ছিল। পরের তারিখ ৬ এপ্রিল। নিস্পৃহ গলায় মা বলেন, ‘‘সরকার নোটবন্দি নিয়ে ভাবে, কিন্তু ধর্ষণকারীদের শাস্তি নিয়ে ভাবে না। রাজনাথ সিংহ থেকে শুরু করে কেজরীবাল, সবার দোরে দোরে ঘুরেছি। কিচ্ছু হয়নি। বিজেপি বলল, দেশের ৬৬০টা জেলায় নাকি নির্ভয়া ক্রাইসিস সেন্টার তৈরি করবে। সেখানে ধর্ষিতা মেয়েদের সব রকম সাহায্য করা হবে। দিল্লিতে সেই সেন্টার ক’টা তৈরি হয়েছে, তার ঠিক নেই। মেনকা গাঁধী তো ওই সেন্টারের নাম থেকে ‘নির্ভয়া’ নামটাই মুছে ‘সখী’ করে দিয়েছেন। এর পরে আর কী আশা করব?’’
এ দিন কলকাতার কাছে এক পরিচিতের ফ্ল্যাটে বসে কামদুনির মা বলেন, ‘‘মাস আটেক আগে নবান্নে মমতা দিদির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। শাস্তির কথা বলতে উনি জানালেন, এ রকম আরও কেস আছে। তাদেরও কিছু হয়নি। সময় লাগবে। কেস কত দূর এগিয়েছে, তা নিয়ে ফোনে কয়েক জনের কাছে খবর নিলেন। মুখ্যমন্ত্রী খুব ভাল মানুষ। অনেক সাহায্য করেন। কিন্তু মেয়ের ধর্ষণকারী-খুনিদের শাস্তির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করা সম্ভব?’’
২০১৩ সালের ৭ জুন ঘটে কামদুনির ঘটনা। ২০১৬ সালে তিন অভিযুক্তের ফাঁসি ও তিন জনের আজীবন কারাবাসের আদেশ দেয় কোর্ট। তার তিন মাস পরেই দুই অভিযুক্তকে সাজা না দিয়ে খালাস করার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যায় রাজ্য। সেই মামলা এখনও শুরু হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের দু’জন ফাঁসি মকুবের আবেদন করে হাইকোর্টে গিয়েছে।
এখন তাই অপেক্ষা আর হতাশা। মায়েদের।