Lok Sabha Election 2019

পিতৃতন্ত্রের চৌকিদার! বদলায়নি রাজ-কাহিনি

অভিযান বেটি বচাও। জয়ধ্বনি ভারতমাতার। কিন্তু কেমন আছেন মেয়েরা

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

চিতোর (রাজস্থান) শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৫
Share:

দেওরালা গ্রামের সতীস্থলে আজও পুজো হয় রূপ কাঁওয়ারের। —নিজস্ব চিত্র।

বাড়ির দরজার দু’পাশে ফুল-লতা এঁকে লেখা, শুভ বিবাহ। সদ্য কোনও অনুষ্ঠান হয়ে থাকবে। তবু দেখলে বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

Advertisement

বাড়িটা মাস্টারজি সুমের সিংহের। সুমের সিংহ, রূপ কাঁওয়ারের শ্বশুর।

১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ১৮ বছরের মেয়ে রূপ ‘সতী’ হয়েছিলেন সুমেরের বড় ছেলের চিতায়। জয়পুর থেকে দেড় ঘণ্টার দূরত্বে বাবলা, আকন্দ আর শেয়ালকাঁটার ঝোপে ঘেরা দেওরালা গ্রাম সেই দিন থেকে ‘কুখ্যাত’। কুখ্যাত, কিন্তু কার কাছে?

Advertisement

সতীস্থল কোন দিকে? জিজ্ঞেস করলে গ্রামের লোক সাগ্রহে দেখিয়ে দেন। তাঁরাই বলে দেন, মাস্টারজির সঙ্গেও দেখা করে যান। ওই ওদিকে বাড়ি! পঞ্চায়েত বা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত হলে অবশ্য আলাদা কথা। প্রকাশ্যে সতী নিয়ে কথা বলতে তাঁরা স্বস্তি বোধ করেন না। কিন্তু ভক্তিভরে প্রশ্ন করলে গ্রামবাসীদের চোখেমুখে কোনও অস্বস্তির চিহ্ন চোখে পড়ে না।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দেওরালা কি তবে বদলায়নি? সরপঞ্চ মহিলা, পুনম কাঁওয়ার। ফোন করলে বাড়ির পুরুষেরাই কথা বলেন। পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে কম্পিউটার আছে, কিন্তু মহিলা সদস্যদের কেউ নেই। তবে ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’ অভিযানে গ্রামের মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অনুপাত ৬০ থেকে বেড়ে ৯০ শতাংশ হয়েছে, শোনা গেল। পঞ্চায়েত অফিসই জানাল, বছর দুয়েক আগে দেওরালার স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় রাজ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করেছিল একটি মেয়ে। বাবা-মা বিয়ে দিচ্ছিলেন বলে, সে কালেক্টরকে গিয়ে বলে আসে, ১৮ না হলে বিয়ে করব না। তার পর? ‘‘তার পর কী? ১৮ হতেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’’ নারীশিক্ষার ওখানেই ইতি।

জোহর মন্দিরে নির্মলা রাঠৌর। —নিজস্ব চিত্র।

রূপও তো দ্বাদশ শ্রেণি অবধি পড়েছিলেন। শ্বশুরমশাই নিজে শিক্ষকতা করতেন। মাস্টারজি এখন আর কানে ভাল শোনেন না। সতীর দর্শন করতে এসেছি জেনে, নিয়ে যান সেই ঘরে, যেখান থেকে শেষ বারের মতো বেরিয়ে রূপ ‘সহমরণে’ গিয়েছিলেন। এখন ঘরের চারপাইয়ে দেবীত্বে অধিষ্ঠিত। নিত্য পুজো পান। সতীস্থলেও তাঁর ছবিতে ধুপধুনো, পাশে মানতের নারকেল। আদালতের নিষেধাজ্ঞায় মন্দিরের কাঠামোটুকুই যা ওঠেনি। প্রতি একাদশীতে গ্রামের মেয়েরা নিয়ম করে পুজো দেন। সতীস্থল আজ গ্রামের প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, বাড়ির পাশে কুয়োর মতোই স্বাভাবিক যেন বা।

রূপ কি ‘সতী’ হয়ে এই অমরত্ব চেয়েছিলেন? কেউ বলেন হ্যাঁ, কেউ বলেন না। সুমেরের বলিরেখা শুধু বলে দেয়, তিনি ঠিক দেবযানী বণিকের শ্বশুর নন, বরং ‘দেবী’র ছবি বিশ্বাস। সতীমাতার রূপকল্প শুধু দেওরালা কেন, রাজস্থান জুড়েই, বিশেষত রাজপুত সমাজের কাছে মারাত্মক উন্মাদনার বিষয়। ঝুনঝুনু-র সতীমাতা মন্দির এমনি এমনি এত লোক টানে না! এমনি এমনি গত বছর ‘পদ্মাবত’কে কেন্দ্র করে জ্বলে ওঠেনি চিতোর!

‘‘স্বাভিমান ছাড়া বেঁচে থেকে কী লাভ বলুন? আমরা তো সত্যিই জোহর করব বলে প্রস্তুত ছিলাম।’’ বলতে বলতে আবেগের কান্নায় গলা আটকে যায় মঞ্জুশ্রী বাম্বোরির। মঞ্জুশ্রী ‘জোহর ক্ষত্রাণী মঞ্চে’র নেত্রী, পদ্মাবত আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ। ‘‘পদ্মিনীর অপমান মানে আমাদের অপমান! পদ্মিনী তো সতীমাতা, দেবী। ওঁকে নিয়ে ছবি হলে জয় সন্তোষী মা-র মতো ছবি হোক! সঞ্জয় লীলা তো তা করলেন না!’’ সেই ক্ষোভে, প্রতিবাদে গত বছর ২১ জানুয়ারি ৫০০ মহিলা লাল ঘুঙ্ঘট (ঘোমটা) মাথায় আর হাতে তরবারি নিয়ে মিছিল করেছিলেন চিতোরে। ২৪ জানুয়ারি কালেক্টরেট অফিসের সামনে জমায়েত করে ঠিক হয়েছিল, কেল্লায় গিয়ে সবাই জোহর করবেন।

মঞ্জুশ্রী বাম্বোরি। নিজস্ব চিত্র

দেওরালায় সতীস্থল, চিতোর দুর্গে জোহর স্থল। কথিত আছে, ওইখানেই চিতোরের মহিলা আর শিশুদের নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন রানি পদ্মিনী। দুর্গের অদূরে ২০০৯ সাল থেকে গড়ে উঠেছে ‘জোহর স্মৃতি সংস্থা’র অফিস। অফিস চত্বরে মেবারের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ তিন জোহর-নারীর বিগ্রহমন্দির। সংস্থার কর্মকর্তারাই জানালেন, আকবরি আমলে জোহর হয়েছিল হোলির এগারো দিনের মাথায়। সেই তিথিতে প্রতি বছর জোহর মেলা হয়। জোহর স্থলে হোমযজ্ঞ দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ে। পদ্মাবত বিক্ষোভের পুরোভাগে করণী সেনার সঙ্গে ছিল জোহর স্মৃতি সংস্থা। ক্ষত্রাণীদের রাস্তায় নামার পিছনে অনুপ্রেরণাও তাঁদেরই। মনে পড়ল, রূপ কাঁওয়ার সতী হওয়ার পরে বিরুদ্ধ সমালোচনার জবাব দিতে সে সময়েও তৈরি হয়েছিল একটা আস্ত সংস্থা, ‘সতীধর্ম রক্ষা সমিতি’। তার অন্যতম নেতা, প্রয়াত রাজনীতিক কল্যাণ সিংহ কালভির পুত্র লোকেন্দ্র সিংহ কালভিই এখন করণী সেনার মাথা। রূপ থেকে পদ্মিনী, তাই অনেকটাই এক সুতোয় গাঁথা।

ক্ষত্রাণী মঞ্চ কোনও নথিভুক্ত সংস্থা নয় অবশ্য। ২০১৪ সালে এই নামে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছিলেন মঞ্জুশ্রী। ঘুঙ্ঘট-এর মাহাত্ম্য, পুজোপার্বণের রীতিরেওয়াজ নিয়ে আলোচনা হত। পরে সেটাই আড়েবহরে বাড়ল। আন্দোলন থিতিয়ে যাওয়ার পরে কালের নিয়মে দলাদলিও জুটল। ইন্দিরা গাঁধীর ভক্ত মঞ্জুশ্রী এখন ‘সমস্ত জোহর মহিলা মণ্ডল’ নামে একটি সংস্থা নথিভুক্ত করেছেন। এখনও আলাদা অফিস খুলতে পারেননি, মেয়েদের নামে জমি নেওয়া যায় না বলে! ও দিকে জোহর সংস্থার মহিলা শাখা হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে ‘জোহর ক্ষত্রাণী সংস্থা’, আন্দোলনের আর এক দাপুটে মুখ নির্মলা রাঠৌর তার প্রেসিডেন্ট। এক সময় পাছে তাঁরা সত্যি জোহর করে বসেন, এই ভয়ে নির্মলার বাড়ি ঘিরে রাখত পুলিশ। নির্মলা গর্বের সুরে বলেন, ‘‘পুলিশ কি জানে, আমার বাড়িতে তখন কত জন মেয়ে লুকিয়েছিল? পোশাকের আড়ালে কী ভাবে দেশলাই বাক্স নিয়ে ঘুরতাম আমরা?’’

নির্মলাদের থামিয়েছিলেন কিন্তু এক অর্থে রূপ কাঁওয়ারই। জোহর হলে সতী-নিবারণী আইনে ফাঁসতে হবে, এই আশঙ্কায় ঘুম উড়েছিল প্রশাসনের। জোহর ভবনের পুরুষেরাও বিপদটা বুঝেছিলেন। তখন ইচ্ছামৃত্যুর অধিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখেন ক্ষত্রাণীরা। সে চিঠির উত্তর আসেনি, ওঁদেরও জোহর করা হয়নি।

কিন্তু নির্মলা-মঞ্জুশ্রীরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন, ওঁদের আন্দোলনটা ছিল সম্মানরক্ষার আন্দোলন। সগর্বে বলেন, ‘‘আমাদের কনুইয়ের নিচ থেকে চুড়ির গোছা পর্যন্ত অংশটুকু ছাড়া আর কিচ্ছুটি খালি পাবেন না। পরপুরুষের কুনজর থেকে ইজ্জত কী করে বাঁচাতে হয়, আমরা জানি।’’ কোনও দিন ভাবেননি রাস্তায় নামবেন! কোনও দিন ভাবেননি পুলিশের মোকাবিলা করবেন! জোহর-এর ‘সম্মান’ রাখতে গিয়েই ওঁদের আগল খুলেছে। পর্দা বাঁচাতে গিয়েই ওঁরা পর্দার বাইরে এসেছেন। রাজনীতির বোলচালও খানিক রপ্ত করেছেন। মঞ্জুশ্রী যেমন বলছেন, ‘‘বসুন্ধরা আমাদের আটকালেন, ছবি তো বন্ধ করতে পারলেন না! মোদীজি চুপ থাকলেন! ওই জন্যই রাজ্যে সরকার উল্টে গেল!’’ নির্মলার বক্তব্য ঠিক উল্টো! ‘‘মোদীজি না থাকলে কি ছবিতে কাটছাঁট হত? বসুন্ধরাজি না চাইলে কি রাজস্থানে ছবি দেখানো থামানো যেত? আমরা মোদীজির সঙ্গে আছি।’’

কংগ্রেস-বিজেপি তরজা তো উপরের খোলস, অন্তরে ওঁরা এক। পিতৃতন্ত্রের ‘চৌকিদার’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement