কোহিনুর চাই না শুনে শীর্ষ কোর্ট তাজ্জব

পুরো জল ঢেলে দিল বলা যাচ্ছে না। তবে আবেগের আঁচে আজ বেশ খানিকটাই জল ছিটিয়ে দিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।কোহিনুর! ব্রিটিশরা যা নিয়ে গিয়েছিল ভারত থেকে। এক দিন আবার সেই ‘হকের ধন’ ফিরিয়ে আনা হবে— আম ভারতীয়ের অনেকের মনেই গেঁথে রয়েছে এই আবেগ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৫
Share:

পুরো জল ঢেলে দিল বলা যাচ্ছে না। তবে আবেগের আঁচে আজ বেশ খানিকটাই জল ছিটিয়ে দিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

Advertisement

কোহিনুর! ব্রিটিশরা যা নিয়ে গিয়েছিল ভারত থেকে। এক দিন আবার সেই ‘হকের ধন’ ফিরিয়ে আনা হবে— আম ভারতীয়ের অনেকের মনেই গেঁথে রয়েছে এই আবেগ। কিন্তু সেটিকে নিয়ে আসার আশাতেই কি ছাই পড়তে চলেছে এ বার? সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে, কোহিনুর ফেরাতে তেমন তৎপর নয় মোদী সরকার। তারই শুনানিতে সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার আজ জানান, কেন্দ্রের সংস্কৃতি
মন্ত্রক মনে করছে, কোহিনুর ফেরত আনার চেষ্টা করা ঠিক নয়। কারণ, ওই হিরে চুরি করে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কেউ তা জোর করে ছিনিয়েও নেয়নি। ব্রিটিশদের এ’টি উপহার দেওয়া হয়েছিল।

ইংল্যান্ডের রানির মুকুট থেকে কোহিনুর ফেরানো নিয়ে কেন্দ্রের অবস্থান জানতে চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সলিসিটর জেনারেলের মুখে এ কথা শুনে তাজ্জব শীর্ষ আদালতও। নড়ে বসেন প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর। সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমারকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে জানতে চান, ‘‘যা বলছেন, তার অর্থ বুঝতে পারছেন তো! ভবিষ্যতে কোহিনুর হিরে নিয়ে আইনি পথে দাবি জানাতে কিন্তু সমস্যা হবে এতে! ওরাই (ব্রিটেন) বলবে, আপনাদের দেশের আদালতই তো কোহিনুর ফেরানোর আর্জি খারিজ করে দিয়েছে।’’

Advertisement

শীর্ষ আদালত যে এই জনস্বার্থ মামলাটি খারিজ করে দিতে আগ্রহী নয়, তা-ও বুঝিয়ে দিয়ে বিচারপতি ঠাকুর প্রশ্ন করেন, ‘‘সবাই বলছে, কোহিনুর তাদের। কতগুলো এমন দেশ রয়েছে জানেন? ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এমনকী, দক্ষিণ আফ্রিকাও। আপনারা জানেন এ সব?’’ প্রশ্নের মুখে সলিসিটর জেনারেল স্বীকার করেন, তিনি এ সব জানেন না। তিনি সরকারের সঙ্গে কথা বলে অবস্থান জানাবেন।

ফলে কোহিনুরের দাবি ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নে মোদী সরকার যে আজই চূড়ান্ত কোনও অবস্থান জানিয়ে দিল, তা নয়। স্বাধীনতার আগের ঘটনা বলে এটা আদৌ সংস্কৃতি মন্ত্রকের বিষয়ও নয়। কোহিনুরের ব্যাপারে কূটনৈতিক চেষ্টা চালাতে হলে সেটা হবে বিদেশ মন্ত্রকের মাধ্যমে। বিদেশ মন্ত্রক এখনও বিষয়টি নিয়ে তাদের বক্তব্য জানায়নি। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট ৬ সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে সুস্পষ্ট অবস্থান জানানোর নির্দেশ দিয়েছে।

কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রক কি সরকারের সামগ্রিক অবস্থান মাথায় না রেখেই কোহিনুরের দাবি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছে? এমনটা মনে করছেন না অনেকে। ফলে সংস্কৃতি মন্ত্রকের অবস্থান নিয়ে এ দিনই জোর হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রকের যুক্তি, পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ আফগান শাসকের থেকে কোহিনুর হিরে পেয়েছিলেন। তিনি তা উইল করে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে দিয়ে যান। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি দলীপ সিংহ ১৮৫০-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে এ’টি তুলে দেন।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ১৮৫০-এ দলীপ সিংহ ছিলেন নাবালক। দ্বিতীয় ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধের পর শিখদের হারিয়ে ব্রিটিশরা শিখ সাম্রাজ্য দখল করে। তার জন্য লর্ড ডালহৌসি লাহৌরের শেষ চুক্তি তৈরি করেন। সেই চুক্তিতেই কোহিনুর-সহ মহারাজার যাবতীয় সম্পত্তি ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়াকে সমর্পণের কথা বলা হয়েছিল। আজ ফেসবুক-টুইটারে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, একে কি উপহার বলা যায়? এ তো নাবালক রাজাকে চাপ দিয়ে কোহিনুর হাতিয়ে নেওয়া। এবং সেই যুক্তিতেই ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় এবং তার পরে ১৯৫৩ সালেও বর্তমান রানি এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় কোহিনুর ফেরানোর দাবি তুলেছে ভারত। কিন্তু চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তা খারিজ করে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝায়ের যুক্তি, ‘‘কোহিনুরের মতো অনেক দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী ইতিহাসে বারবার হাত বদল হয়েছে। যখন যে যুদ্ধে জিতেছে, দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী তার দখলে গিয়েছে। কোহিনুর যেমন প্রথমে ছিল কাকতীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে। তার পর তা মুঘল, আফগান, শিখ রাজত্ব থেকে ব্রিটিশদের হাতে যায়। সেই হিসেবে কোহিনুর কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি নয়। এ’টি মানব সভ্যতার ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য যদি কোথাও সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত হয়, তা হলে তা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সে’টিকে ফেরত আনারও কোনও প্রয়োজন দেখি না।’’ রানির মুকুটে খচিত কোহিনুর এখন সংরক্ষিত রয়েছে টাওয়ার অব লন্ডনে। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অন্যান্য অলঙ্কারের সঙ্গে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ১০৫ ক্যারাটের সেই বিরল হিরে দেখতে ভিড় করেন। দ্বিজেন্দ্রর যুক্তি, ‘‘কোহিনুর বাদ দিলেও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এমন বহু ভারতীয় সামগ্রী রয়েছে। তা হলে সেই সবই ফিরিয়ে আনতে হয়।’’

বছর ছয়েক আগে ভারত সফরে এসে একই যুক্তি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘যদি একটি ক্ষেত্রে হ্যাঁ বলতে হয়, তা হলে এক দিন দেখা যাবে, গোটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।’’ তিন বছর আগে ফের ভারতে এসে ক্যামেরন স্পষ্টই জানিয়ে দেন, ‘‘সকলে হতাশ হবেন শুনে যে, ওটা যেখানে রয়েছে, সেখানেই থাকবে।’’ কিন্তু গত নভেম্বরে মোদী ব্রিটেন সফরে যাওয়ার সময় ফের কোহিনুর ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে। কংগ্রেসের সাংসদ শশী তারুর থেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংসদ কিথ ভাজও কোহিনুর ফেরানোর দাবি তোলেন।

কূটনীতিকরা বলছেন, বিশ্বায়ন ও মুক্ত অর্থনীতির এই যুগে কোনও বড় রাষ্ট্রই আর ইতিহাসের বোঝা টানতে চাইছে না। আমেরিকা কিউবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। কোমাগাতামারু কাণ্ডের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছে কানাডা। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যেও এখন কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সে দিক থেকে ঠিক সিদ্ধান্তই নিচ্ছে নয়াদিল্লি। সংস্কৃতি মন্ত্রকের কর্তাদের যুক্তি, যে সব ঐতিহাসিক সামগ্রী বেআইনি ভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে, শুধু সেগুলিই ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ করা যায়। সংস্কৃতি মন্ত্রী মহেশ শর্মা বলেন, ‘‘বিষয়টি স্বাধীনতার আগের। তাই কেন্দ্রীয় সরকারই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’’

কোহিনুর শব্দের অর্থ আলোর পাহাড়। ইতিহাস বলছে, বারবার ঠিকানা বদলেছে এই পাহাড়। অন্ধ্রের কোল্লুর খনি থেকে আবিষ্কারের পর কোহিনুর ছিল কাকতীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে। এর পর খিলজিদের থেকে এ’টি পায় মুঘলরা। শাহজাহানের ময়ূর-সিংহাসনে এ’টি শোভা পেত। নাদির শাহ দিল্লি লুঠ করে ময়ূর-সিংহাসনের সঙ্গে কোহিনুরও লুঠ করেন। নাদির শাহের সাম্রাজ্যের পতনের পর এ’টি আফগানিস্তানের আমিরদের হাতে আসে। অবিভক্ত পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ লাহৌরের গদিতে বসে সেই আমিরদের সাহায্য করেছিলেন। তার বিনিময়ে তিনি কোহিনুর আদায় করে নেন। সেই কারণেই গত কয়েক দশকে ভারতের পাশাপাশি কখনও আফগানিস্তানের তালিবান শাসকরা, কখনও পাকিস্তানের জুলফিকার আলি ভুট্টোও কোহিনুরের দাবি জানিয়েছেন।

যে হিরে নিয়ে এত টানাটানি, ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের পুরুষরা কিন্তু সেই কোহিনুরকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই দেখে এসেছেন। তাই কোনও রাজা নন। রানির মুকুটেই শোভা পেয়েছে কোহিনুর। সেই সূত্রে এক দিন যা শোভা বাড়াতে পারে ডাচেস অব কেমব্রিজ কেটের। অবশ্য যদি না, ফের ঠিকানা পাল্টে যায় ‘আলোর পাহাড়’-এর। সেই সম্ভাবনা অবশ্য আজ আরও খানিকটা ক্ষীণ হল বলেই মনে করা যেতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement