অপহরণই ব্যবসা হয়েছে উপত্যকায়

বরাকে অপহরণ এখন রোজগারের সহজ উপায়! জঙ্গিদের পাশাপাশি সাধারণ দুষ্কৃতীরাও নেমেছে ওই ‘কাজে’। এই অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে দাবি জানানো দলগুলির নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই। অপহরণ করে টাকা জোগাড় করতেই তারা তৎপর। ওই টাকাতেই অস্ত্র কেনা হয়, চলে প্রশিক্ষণ।

Advertisement

অমিত দাস

হাইলাকান্দি শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৬
Share:

বরাকে অপহরণ এখন রোজগারের সহজ উপায়!

Advertisement

জঙ্গিদের পাশাপাশি সাধারণ দুষ্কৃতীরাও নেমেছে ওই ‘কাজে’। এই অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে দাবি জানানো দলগুলির নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই। অপহরণ করে টাকা জোগাড় করতেই তারা তৎপর। ওই টাকাতেই অস্ত্র কেনা হয়, চলে প্রশিক্ষণ। সাধারণ দুষ্কৃতীরা রীতিমতো দরদাম করে মুক্তিপণ আদায় করে। মনের মতো টাকা না পেয়ে কয়েকটি ক্ষেত্রে অপহৃতকে মেরেও ফেলা হয়েছে। মুক্তিপণ পেয়েও খুন করেছে অনেককে। পুলিশ সূত্রে খবর, অপহৃতকে খুন করার পর মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এ সবে উদ্বিগ্ন বরাকের বাসিন্দারা।

প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী বরাক উপত্যকাকে ‘শান্তির দ্বীপ’ বলেছিলেন। সেই সময় বদলেছে। জঙ্গি, দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে বরাকের মানুষের রাতের ঘুম উড়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, করণিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, চা বাগান ম্যানেজার, চিকিৎসক, ট্রেন চালক, বনকর্মী, আইনজীবী সবারই এক পরিস্থিতি। অপহরণকারীদের নিশানা হতে পারেন যে কেউ। আগের ঘটনাগুলিতে স্পষ্ট, মোটা টাকা মুক্তিপণ না দিলে রেহাই মিলবে না।

Advertisement

গত বছর অগস্টে বরাকে অপহৃত হন কাটলিছড়া এস এস কলেজের শিক্ষক মানিক গুপ্ত। কোনও ভাবে তিনি জঙ্গি শিবির থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন। যদিও পুলিশের দাবি ছিল, তারাই ওই শিক্ষককে উদ্ধার করেছে। ওই ঘটনার পরই করিমগঞ্জ জেলায় রাতাবাড়ি থানার চেরাগি থেকে অপহৃত হন ব্যবসায়ী শেখর দেব। অনেক টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। তবে, ভাঙ্গা এলাকার ব্যবসায়ী শম্ভু দাসের জন্য মুক্তিপণ দেওয়া হলেও, তাঁকে খুন করা হয়। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ হাইলাকান্দি থেকে মিজোরাম যাওয়ার পথে অপহৃত হন বিজেপি নেতা প্রতুলচন্দ্র দেব। অপহরণকারীদের দাবি মেনে মুক্তিপণের কিছুটা টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও প্রতুলবাবুকে খুন করা হয়। তা নিয়ে চলে সিবিআই তদন্তও।

২০০৭ সালে দক্ষিণ হাইলাকান্দিতে ঘাড়মুড়ার শিক্ষক নিধুভূষণ দাস অপহৃত হন। মুক্তিপণ দিয়ে রেহাই পেয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে হাইলাকান্দির সন্তোষনগর থেকে বিপুল খাসিয়াকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। মুক্তিপণের কিছুটা টাকা দেওয়া হলেও, এখনও তিনি ফেরেননি। পরিজনরা বুঝতে পারেন না, তিনি বেঁচে রয়েছেন কি না। ওই বছরই করিমগঞ্জের শনবিল থেকে অপহৃত হন শিক্ষক সদানন্দ দাস। দিন পনেরো পর তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালেই বদরপুর-ভৈরবী লাইনে ট্রেন থামিয়ে চালক প্রমোদ ভট্টাচার্যকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। মোটা টাকা দিয়েই রেহাই পান প্রমোদবাবু।

২০১০ সালেও একটি অপহরণ-কাণ্ড ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়েছিল বরাক উপত্যকায়। প্রবীণ আইনজীবী তফজ্জুল হোসেনকে অপহরণ করে এক দল দুষ্কৃতী। টাকার বিনিময়ে তাঁকে তুলে দেয় অন্য একটি জঙ্গিদলের হাতে। সপ্তাহখানেক পর মুক্তিপণ দিয়ে তিনি ছাড়া পান। কিন্তু অপহরণকারীদের ডেরায় থাকাকালীন তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাড়ি ফেরার কয়েক দিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়।

পুলিশ সূত্রে খবর, হাইলাকান্দিতে অপহরণ-পর্বের সূচনা ২০০০ সালে। সঞ্জয় কুর্মী নামে দক্ষিণ হাইলাকান্দির এক চা বাগান ম্যানেজারকে দুষ্কৃতীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। টাকা পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এতে দুষ্কৃতীদের মনোবল বেড়ে গিয়েছিল। ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি হাইলাকান্দির রামশান্তিপুর থেকে অপহৃত হন ব্যবসায়ী রন্টু গগৈ এবং রিতুল কলিতা। ‘ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন আর্মি’ (উদলা) জঙ্গিরা তাঁদের মুক্তির বদলে ৫০ লক্ষ টাকা দাবি করে। তিন মাস কেটে যাওয়ার পরেও পুলিশ অপহৃতদের খোঁজ পায়নি।

হাইলাকান্দির অতিরিক্ত জেলাশাসক রাজমোহন রায় বলেন, “ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে। জঙ্গিরা অপহৃতদের নিয়ে মিজোরামে গা-ঢাকা দিয়েছে।”

জেলায় আরও আতঙ্ক ছড়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণ হাইলাকান্দির বিলাইপুর থেকে অপহৃত হন অলক দাস। দুষ্কৃতীরা ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ চায়। দু’দিন পর তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর লালা থানার নিজবর্নারপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল জলিলকে একই কায়দায় অপহরণ করে খুন করা হয়। অপহরণকারীরা তাঁর পরিবারের কাছে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল।

এ সবে ক্ষোভ ছড়িয়েছে বরাকজুড়েই। আঙুল উঠছে পুলিশ-প্রশাসনের দিকে। হাইলাকান্দি জেলা কৃষক মুক্তি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিরউদ্দিন বলেন, “শুরুর দিকেই পুলিশ গুরুত্ব দিলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। পুলিশের উদাসীনতায় অপহরণ এখন বিনা লগ্নিতে লাভজনক ব্যবসা হয়ে গিয়েছে।” বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈকত দত্ত চৌধুরীর অভিযোগ, পুলিশ রহস্যজনক কোনও কারণে দুষ্কৃতীদের ঘাঁটাতে চায় না। তিনি বলেন, “দু’বছর আগে হাইলাকান্দিতে এক শিশু চিকিৎসক অপহৃত হন। তৎকালীন বিধায়ক শহিদুল আলমের নেতৃত্বে জনতা অভিযান চালিয়ে যে জায়গা থেকে তাঁকে উদ্ধার করেছিল, তার কয়েক দিন আগে নাকি সেখান থেকেই পুলিশ খালি হাতে ফেরে।”

অতিরিক্ত জেলাশাসক অবশ্য এ সবে পুলিশের ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে নারাজ। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই এলাকা মিজোরাম ও ত্রিপুরার লাগোয়া। তাই অপহরণকারীরা সহজেই অন্য রাজ্যে ঢুকে যেতে পারে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement