গিলানির অন্ত্যেষ্টি ঘিরে অশান্ত শ্রীনগর। সেনাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে বিক্ষোভকারীরা। বৃহস্পতিবার। রয়টার্স
অবিকল বছর দুই আগের অভিজ্ঞতা। ২০১৯-এর ৫ অগস্ট জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে টুকরো করে সরাসরি কেন্দ্রের শাসনে এনে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের দু’দিন আগে মধ্যরাতে আচমকা ভূস্বর্গকে স্থবির করে ফেলেছিল প্রশাসন। সড়কে শুধু রেজর-ওয়্যারের ব্যারিকেড, যানবাহন মাত্রই সাঁজোয়া, প্রকৃতির শব্দকে ছাপিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ভারী বুটের ধুপধাপ। ইন্টারনেট ছিল না, মোবাইল পরিষেবাও স্তব্ধ। কবে যে এই বন্দিদশা উঠবে, জানতেন না কেউ। আর সেই না-জানা ক্রুদ্ধ মানুষ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘরে বসে টেলিভিশন দেখেছেন আর অবর্ণনীয় অবসাদের আবর্তে ডুবে গিয়েছিলেন।
বুধবার বেশি রাতে কিডনির বিকলন এবং স্মৃতিভ্রংশে পর্যুদস্ত ৯১ বছরের হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি দীর্ঘ রোগভোগের পরে প্রয়াত হওয়ার পরে দু’টি সিদ্ধান্ত নেয় কাশ্মীর প্রশাসন। প্রথমত, এই মৃত্যুকে ঘিরে ভারত-বিরোধী জিগির তোলার চেষ্টা রোধ করতে হবে। আর দ্বিতীয়ত, গোটা উপত্যকায় ফের ‘ক্ল্যাম্পডাউন’ কার্যকর করে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বন্ধ করা। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতে মিলে গিয়ে কাগজে-কলমে পরের দিনটির সূত্রপাত ঘটানো মাত্রই স্তব্ধ করে দেওয়া হল গোটা ভূস্বর্গ। রাস্তায় রাস্তায় ফিরে এল ব্যারিকেড, সাঁজোয়া গাড়ি আর নিরাপত্তা বাহিনীর টহলদারি। যে সব সাংবাদিক ও সংবাদ কর্মী বেশি রাতে কাজ সাঙ্গ করে নিয়মিত বাড়ি ফেরেন, তাঁদেরও আটকে দেওয়া হল। ফিরে দফতরেই আপাতত ঘাঁটি গেড়েছেন তাঁরা। এর ফলে সংবাদপত্র বিলি-বিতরণ করা যাক বা না-যাক, সেগুলি প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। কারণ, সরকারি এই ‘ক্ল্যাম্পডাউন’-এ রেহাইয়ের কোনও তালিকা নেই, যাতে সংবাদমাধ্যমের উল্লেখ থাকতে পারত। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক ধাক্কায় স্মার্টনেস হারিয়েছে সব মোবাইল ফোন। পড়ুয়ারা আজ কোনও অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি। উপত্যকায় কেবলমাত্র চালু রাখা হয়েছে সরকারি বিএসএনএল-এর মোবাইল পরিষেবা— এই একটা মাত্র তফাৎ দু’বছর আগের সঙ্গে এ বারের ক্ল্যাম্পডাউনের। গত বারে চালু ছিল না এটাও।
গিলানির পরিবারের অভিযোগ, এ দিন ভোর চারটের সময়ে হায়দরপোরায় বাসভবনে পৌঁছে নিরাপত্তা বাহিনী ‘পরামর্শ’ দেয়, আলো ফোটার আগেই শেষকৃত্য সেরে ফেলতে হবে। বাড়ির কাছের মসজিদের প্রাঙ্গণে কবর খোঁড়ার কাজ সেরেই এসেছিলেন বাহিনীর কর্তারা। নবতিপর নেতার স্বজনেরা কান্নাকাটি করে ‘সময় নষ্ট’ করায় ধৈর্য হারান তাঁরা। গিলানির পুত্র নইম অভিযোগ করেছেন, বলপ্রয়োগ করে কার্যত তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় দেহটি। এ-ও অভিযোগ, বাড়ির মেয়েদেরও ধাক্কা দিয়ে দেহ তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হায়দরপোরা মসজিদে। ভোর ৪টে ৩৭ মিনিটে সেখানে শেষকৃত্য হয় হুরিয়ত কনফারেন্স-এর প্রতিষ্ঠাতা গিলানির। গত বছর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’-এ ভূষিত গিলানির মৃত্যুতে বৃহস্পতিবার অর্ধনমিত ছিল সে দেশের পতাকা। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া।
নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি, গোয়েন্দা তথ্য ছিল, গিলানির দেহ নিয়ে জনতার ঢল নামিয়ে ভারত-বিরোধী জিগির তুলবে জঙ্গি-জেহাদি শক্তি (আফগানিস্তানে তালিবান শাহি কায়েমে যারা উল্লসিত)। তার পরে সেই জিগির কাশ্মীরে ছড়িয়ে অশান্তির আগুন জ্বালানোর ফিকির ছিল পাকিস্তানি চরেদের। তাই, এই ‘কৌশল’। কিন্তু কত দিন চলতে পারে প্রশাসনের ঘোষিত এই ‘ক্ল্যাম্পডাউন’? বলা হয়নি সেটা। তবে শুক্রবার সম্ভবত নয়।