প্রতীকী চিত্র।
দেশ যখন ঘুমন্ত, সে সময় বিচারপতিরা বসলেন মামলা শুনতে। ঠিক এই রকম পরিস্থিতি, রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল হাতে গোনা মাত্র কয়েকবার। বুধবার রাতে অতি বিরল সেই ঘটনার সাক্ষী হল দেশের শীর্ষ আদালত। কর্নাটকে সরকার গঠনের ডাক না পেলে যে কংগ্রেস, জেডি(এস) জোট সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে, সে কথা তারা আগেই জানিয়েছিল। বাস্তবেও হল তাই।
এক টুইটেই নাটক জমজমাট
বুধবার রাত তখন ৮টা।আচমকাই বিজেপি বিধায়ক সুরেশ কুমারের টুইট উস্কে দিল জল্পনা। সুরেশের দাবি, শপথের জন্য বৃহস্পতিবার সকালে ইয়েদুরাপ্পাকে ডেকেছেন রাজ্যপাল বজুভাই বালা।সঙ্গে সঙ্গেই কংগ্রেসের তরফ থেকে পাল্টা টুইট। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তোপ দেগে অভিযোগ, গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যে দু’টি টুইটই মুছে দেওয়া হয়। যদিও এর পরেই সাংবাদিক সম্মেলন করে কংগ্রেস নেতা চিদম্বরম বলেন, কুমারস্বামীর বদলে অন্য কাউকে কর্নাটকে সরকার গঠনের জন্য ডাকা হলে বুঝতে হবে, ঘোড়া কেনাবেচায় উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। ঘোড়া কেনাবেচা না হলে কখনওই একটা সংখ্যালঘু দল সংখ্যাগুরু দলে বদলে যেতে পারে না।
রাত সাড়ে ৯টায় রাজ্যপালের চিঠি
ভুল যে বলেননি বিজেপির সুরেশ কুমার, তার প্রমাণ মিলল রাত সা়ড়ে ৮টায়। চিঠি দিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে শপথ নেওয়ার জন্য ইয়েদুরাপ্পাকে ডাকলেন রাজ্যপাল বজুভাই বালা। চিঠিতে বলা হল, ইয়েদুরাপ্পাকে ১৫ দিনের মধ্যে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে।
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে প্রায় বেনজির শুনানি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সকালেই শপথ ইয়েদুরাপ্পার
রাত তখন সাড়ে ১১টা
কংগ্রেসএবং জেডি(এস) তখন ক্ষোভে ফুটছে। রাজভবনকে কলঙ্কিত করেছেন রাজ্যপাল, সরাসরি এমনই অভিযোগ শোনা গেল কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার গলায়। শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান স্থগিতের আর্জি জানিয়ে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দ্বারস্থ কংগ্রেস ও জেডি(এস)। বলা হয়, সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় সংখ্যা রয়েছে কংগ্রেস এবং জেডি(এস) জোটের। তাই সরকার গঠনের জন্য তাদেরই ডাকা উচিত।আবেদনটি খতিয়ে দেখার পর রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বাসভবনে যান রেজিস্ট্রার। রাতেই মামলাটির শুনানির জন্য বিচারপতি একে সিকারি, বিচারপতি এসএ বোবদে ও বিচারপতি অশোক ভূষণকে নিয়ে তিন সদস্যের বেঞ্চ গড়ে দেন প্রধান বিচারপতি। কংগ্রেস ও জেডি(এস)-এর তরফ থেকে আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি টুইটে বলেন, বিচারবিভাগ কখনও ঘুমোয় না।
আরও পড়ুন: জেডি (এস)-এর সঙ্গে হাত মিলিয়েও কাজ হল না, ইয়েদুরাপ্পা শপথ রুখতে তাই মরিয়া কংগ্রেস
মধ্যরাতে খুলল আদালত
রাত দেড়টা। হাজির তিন বিচারপতি। এর আগে মুম্বই বিস্ফোরণে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত ইয়াকুব মেমনের প্রাণভিক্ষার আবেদন বিবেচনা করার জন্য মাঝ রাতে সুপ্রিম কোর্টের দরজা খুলেছিল ২০০৫ সালে। বেশ কয়েকটি রাজ্যের উদাহরণ টেনে অভিযেক মনু সিংভি জানান, ভোট পরবর্তী জোটকে সরকার গঠনের জন্য ডাকার রেওয়াজ রয়েছে। তবে কেন কর্নাটকে সেই নিয়ম মানা হলনা? বিচারপতিরা প্রশ্ন করেন, ১০৭ জনের সমর্থন নিয়ে কী ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেবেন ইয়েদুরাপ্পা? এর উত্তরেঅ্যাটর্নি জেনারেল কেকে বেণুগোপাল বলেন, সরকার গঠনের চিঠিতে ইয়েদুরাপ্পা কী বলেছেন, জানা নেই। তবে বিধানসভায় আস্থা ভোট হলেই বোঝা যাবে, প্রয়োজনীয় সংখ্যা তাঁর রয়েছে কিনা।
ভোর তখন সাড়ে ৫টা।বিচারপতি বোবদে জানান, ইয়েদুরাপ্পার চিঠি না দেখে আদালত নিশ্চিত করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না।সুপ্রিম কোর্ট জানায়, শপথগ্রহণ স্থগিত করা হবে না। তবে মামলাটি চলবে। রাজ্যপালকে দেওয়া সরকার গঠনের দাবিপত্রে ইয়েদুরাপ্পা ঠিক কী লিখেছিলেন, তা শুক্রবার দেখবে শীর্ষ আদালত।
আইনজ্ঞ তথা সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকেই কিন্তু মনে করছেন, বিজেপি-কে সরকার গড়তে ডেকে রাজ্যপাল বজুভাই বালা কোনও ভুল করেননি। বাংলার প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় বললেন, “সংবিধানে কোনও ধারায় কোথাও বলা নেই, কীভাবে, কাকে, কখন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য ডাকা হবে। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে রাজ্যপালের বিবেচনার উপরে।’’ প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেলের কথায়, ‘‘এই ‘বিবেচনা’ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কংগ্রেস এবং জেডি(এস) কর্নাটক নির্বাচনের আগে জোট করত এবং সেই জোট গরিষ্ঠতা পেত, তা হলে রাজ্যপাল মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য সেই জোটকেই হয়ত আগে ডাকার কথা ভাবতেন। কিন্তু তা হয়নি। ভোট হয়ে যাওয়ার পরে ওই দুই দল জোট গড়েছে। তাই একক বৃহত্তম দল বিজেপি-কে আগে সরকার গড়তে ডেকে রাজ্যপাল কোনও ভুল করেননি।’’ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে ইয়েদুরাপ্পাকে। এই ১৫ দিনে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে না পারেন ইয়েদুরাপ্পা, তা হলে নিশ্চয়ই কংগ্রেস-জেডি(এস) জোটকে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ দেবেন রাজ্যপাল। মন্তব্য বিমল চট্টোপাধ্যায়ের।