কেউ দু’পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে আসছেন, আবার কেউ একসঙ্গে তিন পা এগিয়ে যাচ্ছেন। অসহিষ্ণুতা বিতর্কে বিজেপির হাল অনেকটা এ রকমই। আগের দিন শাহরুখ খানকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে টুইট করেছিলেন বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তাই নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। চাপে পড়ে আজ ক্ষত মেরামতের চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ আবার পাক জঙ্গি হাফিজ সইদের সঙ্গে শাহরুখের তুলনা করে সেই চেষ্টায় জল ঢেলে দিলেন! ফলে দলের অবস্থানটা যে ঠিক কী, সেটা নিয়েই তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে কিছু দিন ধরেই জাতীয় রাজনীতির উত্তাপ বাড়ছে। লেখক-শিল্পী-শিক্ষাবিদ-ইতিহাসবিদ থেকে শিল্পপতি— প্রতিবাদে সরব হয়েছেন অনেকেই। মুখ খুলেছেন আমজাদ আলি খানের মতো প্রবীণ শিল্পী থেকে শাহরুখের মতো জনপ্রিয় তারকা। নরেন্দ্র মোদীর ‘অসহিষ্ণু’ মুখ তুলে ধরতে রাজপথে নেমেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। সুতরাং প্রতি-আক্রমণে যাওয়া ছাড়া যে উপায় নেই, সেটা বুঝে গিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। নরেন্দ্র মোদী বা অরুণ জেটলি যেমন শিখ দাঙ্গার উদাহরণ টেনে কংগ্রেসকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তেমনই দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী অরাজনৈতিক প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে শুরু করেছেন। সেই সূত্র ধরেই মঙ্গলবার শাহরুখের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের চাপেই আজ তাঁকে পিছু হঠতে হয়। কাউকে দুঃখ দিতে চাননি বলে দাবি করে তিনি নতুন টুইট করেন। সেখানে অমিতাভ বচ্চনের পরে শাহরুখই জনপ্রিয়তম তারকা বলে মেনে নেন কৈলাস।
কিন্তু বিজেপির অন্য এক সাংসদ যোগী আদিত্যনাথ এ দিনই শাহরুখকে সরাসরি পাক সন্ত্রাসবাদী হাফিজ সইদের সঙ্গে তুলনা করে বললেন— দু’জনের কথায় একই সুর শোনা যাচ্ছে। ফলে ফের এক দফা হইচই। ঘোলা জলে মাছ ধরতে ছাড়লেন না হাফিজ সইদও। তাঁর নাম করে একটি টুইট-বার্তায় বলা হল, ‘শাহরুখ-সহ ভারতের যে কোনও সংখ্যালঘু মানুষ বৈষম্যের শিকার হলে পাকিস্তানে চলে আসতে পারেন।’ পাক সঙ্গীতশিল্পী গুলাম আলি জানালেন— অবস্থা না-বদলালে আর কখনও ভারতে আসবেন কি না ভাববেন। (খবর পৃঃ৭) পরিস্থিতি সামাল দিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরকে ঘোষণা করতে হল, ‘‘কৈলাস বিজয়বর্গীয় বা যোগী আদিত্যনাথ যে ধরনের মন্তব্য করেছেন, সেটি দলের অবস্থান নয়।’’
দলের অবস্থান তা হলে কী? কী ভাবেই বা দলের নেতারা একের পর এক আলটপকা মন্তব্য করে চলেছেন? তবে কি দলের উপর থেকে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাশ আলগা হচ্ছে? নাকি এই সব অসহিষ্ণু মন্তব্যের পিছনে শীর্ষ নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন মদতই রয়েছে? বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলছেন— আসলে দু’টোই বাস্তব।
বিজেপি সূত্রের মতে, কৈলাস এই মুহূর্তে অমিত শাহের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ নেতা। ফলে তিনি শাহরুখ সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটি যে নেতৃত্বেরই মনের কথা নয়— তা হলফ করে বলা যায় না। মঙ্গলবারের টুইটে তিনি শুধু শাহরুখকে আক্রমণই করেননি, এ-ও লিখেছেন— ‘ভারত যখন রাষ্ট্রপুঞ্জে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে চাইছে, সেই সময় দেশে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হলে পাকিস্তানের মতো দেশেরই হাত শক্ত হবে। শাহরুখের মন্তব্য সেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতই শক্ত করবে।’কিন্তু কৈলাস যদি দলের নীতি মেনেই এ কথা বলে থাকেন, কার্যক্ষেত্রে তাতে সুবিধা হয়নি। বরং জটিলতা বেড়েছে। কেন? দলের এক নেতার কথায়, ‘‘পরিমিতিবোধের অভাব। পাল্টা আক্রমণ করতে গিয়ে কতটা কী বলা হবে, আর তার কী প্রভাব পড়বে, সেটা নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।’’
তবে ওই নেতার অভিযোগ, দাদরির ঘটনার পর দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করার পিছনে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের পরিকল্পিত চক্রান্ত রয়েছে। পুরস্কার-ফেরানো বিশিষ্ট জনেরাও সেই দলে। তাঁর দাবি, দেশে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে সনিয়াকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রা করতে হবে। জাভড়েকরও এ দিন বলেন, ‘‘কোনও ঘটনার জন্যই বিজেপি দায়ী নয়। কিন্তু দোষ পড়ছে আমাদের উপরে। এর মোকাবিলা করার প্রয়োজন রয়েছে।’’ আর সে কারণেই খোদ প্রধানমন্ত্রী শিখ-বিরোধী দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে বা দলের অন্য নেতারা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উচ্ছেদ থেকে শুরু করে অন্য ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাল্টা অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলেছেন।
কিন্তু সে সব তো রাজনৈতিক তরজা। বিজেপির অন্দরেই বড় অংশের মত হল, শাহরুখের মতো ব্যক্তিত্বের কথার উত্তর দিতে হলে বিশিষ্ট জনেদের আসরে নামানো দরকার। কিন্তু তেমন প্রভাবশালী বিশিষ্ট জনের বড়ই অভাব তাঁদের শিবিরে। ফলে শাহরুখের জবাবে কৈলাস-আদিত্যরাই মুখ খুলছেন। আর সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। আপাতত খুঁজেপেতে অভিনেতা অনুপম খেরকে বিজেপি কিছুটা টানতে পেরেছে, যিনি আগামী ৭ নভেম্বর পুরস্কার-ফেরত-দেওয়া শিল্পীদের বিরুদ্ধে দিল্লিতে রাস্তায় নামতে রাজি হয়েছেন। পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকর, অশোক পণ্ডিতদের নিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রা করবেন। রাষ্ট্রপতিকে বলবেন, শুধুমাত্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই প্রতিবাদ হচ্ছে।
কিন্তু তার আগেই কৈলাস-আদিত্যরা যে কাণ্ড ঘটালেন, তাতে অনুপমদেরও মুখ পুড়ল। যে কারণে আজ অনুপমকেও বলতে হল, ‘‘বিজেপির কিছু নেতার মুখে সত্যিই কুলুপ আঁটা দরকার। শাহরুখ সম্পর্কে এ ধরনের আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। শাহরুখ জাতীয় আইকন এবং আমরা তাঁর জন্য গর্বিত।’’ শাহরুখকে ‘দেশদ্রোহী’ বলার সমালোচনা করেছেন মধুর ভান্ডারকরও। মোদীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তারকা সলমন খান শাহরুখের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘আমরা সবাই ভারতীয়।’’ এমনকী শাহরুখের হয়ে মুখ খুলেছে বিজেপির জোটসঙ্গী শিবসেনাও। সেনা-মুখপাত্র সঞ্জয় রানাউতের বক্তব্য, ‘শাহরুখ মুসলিম বলে তাঁকে নিশানা করা
ঠিক নয়।’
কিন্তু তা হলে কি বিজেপির মাঝারি নেতাদের আলগা সব মন্তব্য একেবারেই নেতৃত্বের না-পসন্দ বলে মনে করতে হবে? নাকি নরমে-গরমে চলাটাই নেতৃত্বের কৌশল? বিজেপি নেতারা ঘরোয়া স্তরে অস্বীকার করছেন না, বিহারের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় শেষ দফার ভোটে মেরুকরণের রাজনীতির ফায়দা তাঁরা ঘরে তুলতে চাইছেন। কংগ্রেস তাই দাবি করছে, গোটাটাই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন মদতে। কংগ্রেস মুখপাত্র আনন্দ শর্মা আজ বলেন, ‘‘শাহরুখের জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যাঁরাই অসহিষ্ণুতার সমালোচনা করছেন, তাঁরাই যেন শত্রু। প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন?’’
উত্তরে জাভড়েকরের মন্তব্য, ‘‘এ কথা ঠিক, দাদরির ঘটনার পর আমাদের প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন খবরের কাগজে যা যা প্রকাশিত হবে, সব বিষয়ে মন্তব্য করা প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়।’’ ফলে পাল্টা আক্রমণের পথটি যে বিজেপি ছা়ড়বে না, সেটা স্পষ্ট।
কিন্তু দলের একাংশের বল্গাহীন কথাবার্তা তাঁদের বারে বারে পিছিয়েও দিচ্ছে। অবস্থা সামাল দিতে মোদী-অমিত এখন কী করেন, সেটাই দেখার।