পাসপোর্ট: বিধিতে সুরক্ষার ফাঁক, আশঙ্কায় গোয়েন্দারা

পাসপোর্ট ক্ষেত্রে সার্বিক সংস্কারের চাহিদা ছিল দীর্ঘদিনের। সময়ের দাবি মেনে সেই সংস্কার হল বটে। কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কার মূলত হয়ে দাঁড়াল সামাজিক।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৪৭
Share:

পাসপোর্ট ক্ষেত্রে সার্বিক সংস্কারের চাহিদা ছিল দীর্ঘদিনের। সময়ের দাবি মেনে সেই সংস্কার হল বটে। কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কার মূলত হয়ে দাঁড়াল সামাজিক। আধুনিক জঙ্গিবাদের মুখে দাঁড়িয়েও দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে ফাঁক রেখে দিল নতুন পাসপোর্ট নীতি।

Advertisement

সীমান্তের ও-পার থেকে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। আবার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসে এখন নাম জড়াচ্ছে ভারতেরও। দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে সংখ্যালঘু যুবকেরা আইএসের ‘খিলাফৎ’ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যোগ দিতে ভারত ছাড়ছেন বলেই জেনেছেন গোয়েন্দারা। এঁদের অধিকাংশই ভুয়ো পাসপোর্ট জোগাড় করে সিরিয়া-ইরাক পাড়ি দিয়েছেন। তদন্তে জানা গিয়েছে, পাসপোর্টে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া হচ্ছে এঁদের পরিচয়। আর এই কাজেই ব্যবহার করা হয়েছে জাল আধার বা প্যান

কার্ড (পাসপোর্টের আবেদন করার সময়ে যেগুলির প্রতিলিপি সচিত্র পরিচয়পত্র হিসেবে জমা দিতে হয়)। গত কালের সংস্কার এই নথি-জালিয়াতির আশঙ্কার দরজাটাই হাটখোলা করে দিয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।

Advertisement

কী ভাবে? যেমন, নতুন নিয়মে গণ্য হয়েছে স্কুল ছাড়ার শংসাপত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো নথি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এমনিতেই গোটা দেশে ভোটের সচিত্র পরিচয়পত্র, প্যান বা আধার জাল কার্ড করার একাধিক চক্র রয়েছে। তার ওপর স্কুলের শংসাপত্রের মতো নথি জাল করা আরও সোজা। গত দেড় বছরে কেবল দিল্লিতেই অন্তত ৪০০টি ভুয়ো পাসপোর্ট উদ্ধার হয়েছে।

আরও আছে। নতুন নিয়ম বলছে, বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতিকে পাসপোর্টের আবেদনে প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর নাম লিখতে হবে না। আশঙ্কা এই নিয়মকে ঘিরেও। গোয়েন্দারা বলছেন, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে নাশকতার উদ্দেশ্যে এ দেশে আসা জঙ্গিরা সচরাচর প্রথমেই স্থানীয় কোনও মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করে নেয়। এর পর বিয়ের সূত্র ধরে জোগাড় হয় অন্যান্য পরিচয়পত্র, যা তাকে ‘ভারতীয়’ পরিচয় দেয়। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘এ বার ওই ব্যক্তি যদি তালাক দিয়ে পাসপোর্টের আবেদনে প্রাক্তন স্ত্রীর নাম না লেখে, তা হলে তার ইতিহাস জানা মুশকিল। এক বার আধার বা প্যান কার্ড পেয়ে গেলে পাসপোর্ট জোগাড় করাটাও ওই জঙ্গির পক্ষে এমন কিছু অসম্ভব হবে না। ভারতীয় পাসপোর্ট হাতে পেলে তার পক্ষে নাশকতার উদ্দেশ্যে অন্য দেশে যাওয়া সহজ হবে। আবার নাশকতার প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য দেশ থেকে ‘বৈধ নাগরিক’ পরিচয়ে ভারতে ঢুকতেও সমস্যা হবে না।’’

পাসপোর্টের আবেদনে সংযোজনীর সংখ্যাও ১৫ থেকে কমে হয়েছে ৯। একাধিক সংযোজনীতে বলা হয়েছে, সরকারি কর্তা বা বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের শংসাপত্রের পরিবর্তে আবেদনকারীর নিজের প্রত্যয়িত নথি দিলেই চলবে। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরেই সরকারি কাজে শংসাপত্র প্রত্যয়িত করানোর পদ্ধতি তুলে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল, দেশের মানুষকে অবিশ্বাস করা ঠিক নয়। কিন্তু গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, অসৎ উদ্দেশ্যে যারা পাসপোর্ট বানায়, তারা এই নিয়মের ফায়দা তুলতেই পারে! প্রাক্তন বিদেশসচিব কানওয়াল সিব্বলের মতে, অনেক সময়ে মৃত ব্যক্তির পাসপোর্ট পুনর্নবীকরণ করে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু পরিবারের লোক তা জানতেই পারেন না। কাজেই এই ধরনের ঝুঁকি তো থাকছেই।

নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থার জন্য কী দরকার?

প্রাক্তন কূটনীতিক রণেন সেনের মতে, ‘‘আধুনিক দেশগুলির মতো এ দেশেও বায়োমেট্রিক পাসপোর্টের ব্যবহার শুরু করতে হবে।’’ এই ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে সব তথ্য পাসপোর্টের মধ্যেই একটি চিপ-এ ভরা থাকবে। যার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে মূল সার্ভারের। যাতে প্রয়োজনে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে পাসপোর্টের তথ্য সত্যি কি না, তা মুহূর্তে যাচাই করা সম্ভব হবে। বর্তমানে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য ১৯৩টি দেশের মধ্যে ৯৩টি দেশে চালু রয়েছে ই-পাসপোর্ট তথা বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট। দেরিতে নড়ে বসলেও ২০২০ সালের মধ্যে ই-পাসপোর্ট চালু করতে চায় ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, ই-পাসপোর্টই ভবিষ্যৎ। তবে ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে এই ব্যবস্থা চালু করতে সময় লাগবে।

মন্ত্রকের যুক্তি, পাসপোর্টের নতুন নিয়মে সিঙ্গল পেরেন্টদের ক্ষেত্রে এক জনের নাম লেখার মতো বিষয়গুলি সময়ের চাহিদা। সেই দাবি মেনেই এই বদল। যদিও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, পাসপোর্টে শুধুই জনমোহিনী নীতি নিতে গিয়ে হয়তো দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে ফেলল কেন্দ্র। ঠিক যেমন পরিকাঠামো তৈরি না করেই তড়িঘড়ি নোট বাতিল করে মুশকিলে ফেলা হল আম আদমিকে। যার উত্তরে বিদেশ মন্ত্রক আবার বলেছে— নিয়ম শিথিল করা হয়েছে বটে, কিন্তু নিরাপত্তা প্রশ্নে কোনও ঢিল দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে ‘ক্রস চেকিং’ আরও বাড়ানো হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement