ইন্দিরা গাঁধী ও আর কে ধওয়ন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
তিনি মুখ খুললে ভারতীয় রাজনীতিতে একাধিক পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ হতে পারত। সাত-আটের দশকের বহু বিতর্কের অগ্নিকুণ্ডে ঘৃতাহুতির সম্ভাবনা ছিল। আবার অবসান হতে পারত অনেক কেলেঙ্কারির। তিনি রাজেন্দ্র কুমার ধওয়ন, যাঁর বেশি পরিচিতি আর কে ধওয়ন নামেই। ইন্দিরা গাঁধী জমানার আপ্ত সহায়ক, উপদেষ্টা, পরামর্শদাতা। চলেও গেলেন নীরবেই। সোমবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন এমন বহু প্রশ্নের উত্তর, যেগুলি গাঁধী পরিবারের বাইরে শুধু তিনিই জানতেন। কী জানতেন তিনি?
১৯৭৫-এর জানুয়ারি। জরুরি অবস্থা জারির মাস ছয়েক আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ইন্দিরা গাঁধীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। জরুরি অবস্থা জারি করার আগে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সেই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলার বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা। বলতে গেলে আর কে ধওয়নের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত গাঁধী পরিবারের বাইরে আসা এটাই একমাত্র নথি। হাতে লেখা ওই চিঠির একটি কপি সেই সময় বিশিষ্ট সাংবাদিক কুমি কাপুরের হাতে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে কুমি কাপুর তাঁর বই ‘দ্য এমার্জেন্সি: এ পারসনাল হিস্ট্রি’-তে উল্লেখ করেছেন।
বহির্জগতের কাছে তাঁর পদ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বা আপ্ত সহায়ক হলেও ইন্দিরার সময়ে তিনিই ছিলেন শেষ কথা। ক্ষমতার বৃত্তে না থেকেও ছিলেন অসীম ক্ষমতাধর। তাঁর ইচ্ছাই ছিল কার্যত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার উপদেশ। মন্ত্রী না হয়েও ছিলেন সব মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রক। সরকারি কোনও পদে না থেকেও হয়ে উঠেছিলেন সরকারের পথ প্রদর্শক। বিপদের উদ্ধারকর্তা। সামান্য স্টেনো হয়ে গাঁধী পরিবারে প্রবেশ করেও প্রশ্নবিহীন আনুগত্য, নিরলস পরিশ্রম আর অভাবনীয় কৌশলে কাজ করার দক্ষতাই ধওয়নকে করে তুলেছিল ভারতীয় রাজনীতির সেকেন্ড ম্যান।
রাহুল, প্রিয়াঙ্কা ও ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে আর কে ধবন (পিছনে সাদা জামা)। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
কীভাবে?
নেহরু-গাঁধী পরিবারে ধওয়নের প্রবেশ ঘটেছিল যশপাল কপূরের হাত ধরে। নেহরুর আস্থাভাজন ছিলেন যশপাল। সেই কারণেই কাকার সুপারিশে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর দলীয় কার্যালয়ে স্টেনো হিসাবে কাজ পান ধওয়ন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কর্মক্ষেত্রে বদলে হয় তিন মূর্তি হাউসে, ইন্দিরা গাঁধীর সাহায্যকারী হিসাবে। সেখানে তাঁর নির্দিষ্ট কোনও কর্মক্ষেত্র বা পদমর্যাদা ছিল না। অথচ দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে এবং মুখ বন্ধ রেখে কাজ করা, রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম আর আনুগত্যের গুণেই ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে চলে আসেন। যশপাল সক্রিয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় তাঁর জায়গা ধীরে ধীরে পূরণ করতে শুরু করেন ধওয়ন। অচিরেই হয়ে ওঠেন ইন্দিরার ব্যক্তিগত সচিব এবং বিশেষ আপ্ত সহায়ক। কংগ্রেসের ‘অপরিহার্য’ ব্যক্তি। অনেকেই বলতেন ‘আইজ অ্যান্ড ইয়ারস অব ইন্দিরা’ বা ‘ইন্দিরার ইন্দ্রিয়’। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এবং বাকি রাজনৈতিক জীবনে তাঁর চোখ দিয়েই দেখতেন, তাঁর কান দিয়েই শুনতেন ইন্দিরা।
কলকাতায় নেতাজি ইন্ডোরে এআইসিসি-র প্লেনারি সেশনে প্রণব মুখোপাধ্যায় ও মাধবরাও সিন্ধিয়ার সঙ্গে আর কে ধওয়ন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
আরও পড়ুন: নিতিন গডকড়ীর ভুল চালকেই হাতিয়ার করে প্রশ্ন রাহুলের, ‘দেশে কাজ কই?’
তাই তাঁর ইঙ্গিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। তাঁর আদেশ ছিল ইন্দিরার শেষ কথা। যা না মানা ছিল কার্যত দেশদ্রোহিতার সমান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কে দেখা করতে পারবেন, কার অধিকার নেই, কতক্ষণ কথা বলার সময় সবই ঠিক করতেন ধওয়ন। ইন্দিরার হয়ে আমলা-মন্ত্রীদের তিনিই নির্দেশ দিতেন। আবার ইন্দিরার রাজনৈতিক জীবনেও তিনি ছিলেন ক্রাইসিস ম্যানেজার, মার্গদর্শক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এই ধওয়নের জন্যই জরুরি অবস্থার সময়ের চরম সঙ্কটের পরও ৮০ সালের নির্বাচনে ফের জিতে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে পেরেছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। আবার প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত গোপনীয় কোনও গোপন ফাইলও তিনি অনায়াসেই দেখতে বা পড়তে পারতেন। তাঁর সেই অধিকার ছিল। তিনি দেখেছেনও। অথচ কোনও গোপনীয়, বা বিতর্কিত বিষয় তাঁর মুখ থেকে কখনও শোনা যায়নি।
আরও পড়ুন: পিছিয়ে গেল ৩৫এ শুনানি, স্তব্ধ কাশ্মীর
সমস্যাও অবশ্য ছিল। ধওয়নের উত্থানে ভিতরে ভিতরে কংগ্রেসের অন্দরে অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ্যে তা কেউই বলতেন না। অনেকেই বলেন, সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় হয়ে উঠেছিল ‘দ্বাররক্ষী’দের কুক্ষিগত। একছত্র ক্ষমতা ভোগ করতেন তাঁরাই। সেই সময় ইন্দিরা গাঁধীর যুগ্ম সচিব বিশন ট্যান্ডন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘যখনই কোনও বিষয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য যেত, সিদ্ধান্ত নেওয়া হত দ্বারপালদের অনুমতি আছে কি না, তার উপর নির্ভর করে। আর ফাইল গেলে প্রধানমন্ত্রী তো পড়েও দেখতেন না।’’
হোটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর কে ধওয়ন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
এই ক্ষোভের বারুদ ভিতরে ভিতরে ধিকি ধিকি জ্বলছিলই। তাতে অগ্নি সংযোগ হল ইন্দিরা-হত্যার পর। বিশেষ করে নেহরু-গাঁধী পরিবারে বরাবর পঞ্জাবি লবির প্রভাবে যাঁরা ঈর্ষাকাতর ছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেই সময় কলকাঠি নাড়তে শুরু করলেন। ইন্দিরা হত্যায় গঠিত হল ঠক্কর কমিটি। কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হল, সূচাগ্র্য হলেও হত্যার পরিকল্পনায় ধওয়নের দিকে সন্দেহের তির থেকেই যায় (যেহেতু গাঁধী হত্যার সময় মঞ্চে ছিলেন তিনি)। সেই সন্দেহের বশে, আদপে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী কোন্দলের শিকার হলেন ধওয়ন। এমনকী, এও ভাসছিল, গ্রেফতার হতে পারেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
ফিরতেও অবশ্য বেশি দিন সময় লাগেনি। ইন্দিরা হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজীব গাঁধী। বছর দু’য়েকের মধ্যেই বিরোধীদের তীব্র আক্রমণে চাপে পড়লেন রাজীব। তার মধ্যেই সামনে চলে এল বোফর্স কেলেঙ্কারি। তীব্র ভাবে আরও চেপে ধরলেন বিরোধীরা। সেই সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন রাজীব। তখনই অবিসংবাদিত ভাবে উঠে আসে ধওয়নের নাম। রাজীবও চাইছিলেন এমন একজন পোড় খাওয়া দক্ষ ব্যক্তিকে, যিনি এই ধরনের সঙ্কটে বহুবার ত্রাতা হয়ে উঠেছেন তাঁর মায়ের শাসনকালে। স্বাভাবিকভাবেই ইন্দিরা হত্যার অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে ফের স্বমহিমায় ফিরে এলেন ধবন। নিযুক্ত হলেন রাজীবের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি পদে। তখনও তিনি রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংহর সঙ্গে রাজীবের সংঘাতে বারবার শান্তি দূতের ভূমিকা পালন করেছেন। সমন্বয় বজায় রেখেছেন সরকারের সঙ্গে রাইসিনা হিলসের। রাজীবের মৃত্যুর পরও কংগ্রেস তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রেখেছে। তারপর সরাসরি রাজনীতিতে আসেন ধওয়ন। পরপর দু’বার রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন। ছিলেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। নরসিমা রাও মন্ত্রিসভায় তিনি সামলেছেন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী।
আরও পড়ুন: ডিএমকে সুপ্রিমো করুণানিধির অবস্থা সঙ্কটজনক, হাসপাতালে ভিড় অনুগামীদের
এ হেন বর্ণময় এক চরিত্র বরাবর পেশাগত গোপনীয়তা রক্ষা করে চলা ধওয়ন বৃদ্ধ বয়স পর্যন্তও অকৃতদার ছিলেন। অবশেষ ৭৪ বছর বয়সে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী অচলাকে বিয়ে করেন। সোমবার ৮১ বছর বয়সে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একান্ত ঘনিষ্ঠ মহলেও যিনি কখনও অসাবধানতা বশতও এমন কোনও গোপনীয় তথ্য প্রকাশ্যে আনেননি, যা তাঁর পেশাগত এবং কর্মজীবনের পরিপন্থী। ভারতবর্ষ তাঁকে মনে রাথবে কাজপাগল অথচ দায়বদ্ধ, কর্মতৎপর অথচ হিমশীতল মস্তিষ্ক, আড়ালে থেকেও বহু সংকটে উদ্ধারকারী এবং দক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক রাজনীতিবিদ হিসাবেই।