‘রাজা উলঙ্গ’ হয়ে গিয়েছে কবেই! তার রাজ্যপাট গিয়েছে!
কবেই হাতছুট হয়ে গিয়েছে উপনিবেশ।
আর সেই ‘রাজা’র তাঁবে ছিল যারা এক দিন, তারাই এ বার পশ্চিম এশিয়ায় কোনও দেশের সুলতানশাহীকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে চলেছে।
ষোলো আনার মধ্যে যে এক আনা পড়ে ছিল, পশ্চিম এশিয়ায় ব্রিটেনের সেই শেষ সামরিক ঘাঁটি ব্রুনেইও এ বার হাতছাড়া হতে চলেছে রানি ভিক্টোরিয়ার দেশের!
আর তার জায়গায় এ বার ব্রুনেইয়ের সুলতানশাহী রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে চলেছে সেই ভারত, এক সময় যে দেশে ছিল ব্রিটেনের বৃহত্তম উপনিবেশ?
বুধবার ব্রুনেই সফরে গিয়ে ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি মহম্মদ হামিদ আনসারি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় ব্রুনেইয়ের সুলতানকে প্রস্তাব দিয়েছেন, তিনি চাইলে তাঁর সুলতানশাহী পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে ভারত তার সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত দুঁদে অফিসার ও জওয়ানদের পাঠাতে পারে ব্রুনেইয়ে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই লড়াকু গোর্খা রেজিমেন্ট। কুমায়ুনে।
গত এক শতাব্দী ধরে তেলে ভেসে যাওয়া ছোট্ট দেশ ব্রুনেইয়ের সুলতানশাহী পাহারা দেওয়ার জন্য তার এক সময়ের উপনিবেশে সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টকেই রেখে চলেছে ব্রিটেন। ১৯৮৪ সালে ব্রুনেই স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টকে তাঁর দেশ পাহারা দেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে পারিশ্রমিক দিয়ে যেতে হচ্ছে ব্রুনেইয়ের সুলতানকে।
আরও পড়ুন- সুখোই থেকে ব্রহ্মস নিক্ষেপের প্রস্তুতি, ইতিহাস তৈরির পথে ভারত
অর্থটা বড় কথা নয় তেলে ভেসে যাওয়া ব্রুনেইয়ের সুলতানের কাছে। তাঁর কাছে অনেক বেশি উদ্বেগের বিষয় দক্ষিণ চিন সাগর। যেখানে ব্রুনেইয়ের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে চিন। দক্ষিণ চিন সাগরের সেই ব্রুনেই-লাগোয়া অংশটাকেও বেজিং তার ‘নিজের’ বলে দাবি করছে, যা ফের এক সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ায় ভারতের মতো একটি শক্তিশালী দেশকে পাশে পাওয়াটা খুব দরকার হয়ে পড়েছে ব্রুনেইয়ের সুলতানের। দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের ‘দাদাগিরি’ দিল্লিরও তেমন পছন্দ নয়। তাই ব্রুনেইকে পাশে পাওয়াটা দরকার দিল্লিরও।
ব্রুনেইয়ের দারউস-সালেম।
সেই লক্ষ্যেই ব্রুনেই সফরে গিয়ে ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি সে দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তি করেছেন। তাতে ব্রুনেইয়ের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও দু’দেশের সেনাবাহিনীর যৌথ মহড়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ভারতের তরফে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক ‘সুলভে’ ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নেওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখতে দিনকয়েকের মধ্যেই দিল্লিতে আসছে ব্রুনেইয়ের একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল।
তবে বিষয়টি যেহেতু স্পর্শকাতর, তাই ভারতের বিদেশমন্ত্রক এখন দৃশ্যতই এ ব্যাপারে কিছুটা ‘রক্ষণাত্মক’। কিছুটা ঢেকে-চেপে কথা বলতে চাইছে। বিদেশমন্ত্রকের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘আমরা এ ব্যাপারে ব্রুনেইয়ের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেটা ব্রুনেই রাখবে কি না, তার ওপরেই নির্ভর করছে। এমনও হতে পারে, সেনা জওয়ান না পাঠিয়ে শুধুই দেহরক্ষী পাঠানো হল ব্রুনেইয়ের সুলতান আর তাঁর পারিষদদের জন্য।’’
কিন্তু সেটা কি এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ শক্তিধর দেশ ভারতের পক্ষে মর্যাদাজনক হবে?
তাই অন্য আরও কারণ রয়েছে বলে কূটনীতিকদের ধারণা।
সেগুলো কী কী?
এক, চিনের বাড়-বাড়ন্তের সঙ্গে পাল্লা দিতে ‘লুক ইস্ট পলিসি’কে তড়িঘড়ি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ভারতের। তার নিজের স্বার্থেই। আর সে জন্যই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে নানা ভাবে দহরম-মহরম বাড়াতে চাইছে দিল্লি। তা সে আর্থিক সাহায্য দিয়েই হোক, বা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।
দুই, ব্রুনেইয়ের মতো ছোট্ট একটা দেশে রয়েছেন দশ হাজারেরও বেশি ভারতীয়। তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাটা যেমন দিল্লিরও কিছুটা দায়িত্ব, তেমনই তাঁরা যেহেতু ব্রুনেইয়ের শিল্পে অন্যতম বড় একটা শ্রম-শক্তি, তাই তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া আর সেই সূত্রে ভারতের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখাটাও খুব দরকার ব্রুনেইয়ের।
তিন, ব্রুনেই যেহেতু তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে ভাসছে, তাই সে দেশ থেকে সুলভে আরও বেশি তেল আমদানি করাটাও দরকার দিল্লির।
চার, আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে গত কয়েক মাসে যে ভাবে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে তেলের দাম, তাতে সুলতানশাহীর পাহারায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নকে রাখার খরচ পোষাতে পারছে না ব্রুনেই।