মাঘ মেলায় কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত। রবিবার প্রয়াগরাজে। পিটিআই
দেশকে অন্ন জোগান তাঁরা। কিন্তু শিক্ষার, বিশেষত বিদেশি ভাষা শিক্ষার আলো কৃষকদের উপরে এখনও সে-ভাবে পড়েনি। অথচ তাঁদের নিজস্ব ‘মাটির ভাষা’য় উন্নত কৃষি-প্রযুক্তি, কৃষিঋণের তথ্য এবং সেই সব সুযোগ নেওয়ার খোঁজখবর মেলে না এখনও। ওই সব তথ্য ও সুলুকসন্ধান যে-ভাষায় এবং যে-ঢঙে লেখা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা কৃষকদের বোধগম্য হয় না। জটিল বৈজ্ঞানিক ভাষা মূলত ইংরেজিতে উপস্থাপিত হওয়ায় সেগুলো বুঝতে কৃষকেরা গলদ্ঘর্ম হন। এই সমস্যার সুরাহায়, অন্নদাতাদের সঙ্গে ভাষাগত দূরত্বের অবসান ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)। বাংলা ভাষা নিয়ে এই কাজে আইআইএসসি-র সঙ্গে রয়েছে রাজ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ম্যাকাউট)। শুধু এ-পার বাংলা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন উপভাষা নিয়েও কাজের পরিকল্পনা চলছে।
কৃষকেরা যে-কথ্য ভাষায় ভাব প্রকাশ করেন, মাটির কাছাকাছির যে-ভাষা তাঁরা বুঝতে ও বোঝাতে পারেন, সেই সব উপভাষাতেই তৈরি হচ্ছে কৃষি ও আর্থিক সমস্যা সমাধানের অ্যাপ। কৃষকেরা বিনামূল্যে এই অ্যাপ সাধারণ স্মার্টফোনে ব্যবহার করতে পারবেন। শুধু জানাই নয়, কৃষকেরা ওই অ্যাপের মাধ্যমে প্রশ্ন করে তাঁদের সমস্যার সমাধানও পাবেন।
ম্যাকাউট-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ভারতের অন্তত ৭০% মানুষ কৃষিনির্ভর। তাঁদের একটা বড় অংশ শিক্ষার আলো দেখেননি, দেখলেও বিদেশি বা বৈজ্ঞানিক ভাষায় অভ্যস্ত নন। কৃষি উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বা কৃষিঋণ সংক্রান্ত তথ্য সাধারণকে জানানোর জন্য অ্যাপ-নির্ভর পরিষেবা নতুন নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই সব তথ্য এমন ভাবে ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, যা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই তথ্য ইংরেজি ভাষায় পরিবেশন করায় সাধারণের কাছে তা তেমন গ্রহণযোগ্য হয় না। কিছু জানার থাকলেও ভাষার সমস্যায় তা জানা হয়ে ওঠে না।
ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে উপভাষা প্রচুর। সেই উপভাষাই যাঁদের ভাষা, তাঁদের সেই নিজের ভাষায় এই সব তথ্য পৌঁছনো জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই 'রেসিপিন' নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন আইআইএসসি-র বিজ্ঞানীরা। আমেরিকার গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থসাহায্যে শুরু হয়েছে এই প্রকল্প। তার আওতায় রয়েছে ভারতের ন’টি ভাষা এবং তাদের উপভাষা। বাংলা তার অন্যতম। বাংলা ভাষা সংক্রান্ত পুরো কাজটি করতে আইআইএসসি সঙ্গে পেয়েছে ম্যাকাউটকে।
বাংলায় এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছে ম্যাকাউটের টেকনোলজি সেল। এই সেলের প্রধান প্রীতিময় সান্যাল জানান, সমগ্র গবেষণার কাজটি মূলত দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি ভাগে এ রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে কৃষি ও আর্থিক বিষয়ক উপভাষাগুলি সংগ্রহ করা হচ্ছে। অন্য ভাগে এই উপভাষা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে তা শেখানো হচ্ছে কম্পিউটারকে। প্রাথমিক ভাবে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের প্রায় ১২টি উপভাষায় কথা বলেন, বিভিন্ন স্তরের এমন মানুষজনের কাছে গিয়ে তাঁদের ভাষা রেকর্ড করা হচ্ছে এবং কম্পিউটারকে তা শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রীতিময়বাবু বলেন, ‘‘কম্পিউটারের এই শিক্ষণ পদ্ধতি শেষ হয়ে গেলে বাংলার যে-উপভাষাতেই কথা বলা হোক, তা সে সহজে বুঝতে পারবে, সেই উপভাষায় সমস্যার সমাধানের পথও বাতলে দেবে। বাংলা ভাষায় এই ধরনের উপভাষা-কেন্দ্রিক কাজ এই প্রথম বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ম্যাকাউটের উপাচার্য সৈকত মৈত্র জানান, বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি যে-হেতু বিশাল, তাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কথাও ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের উত্তর থেকে দক্ষিণে বিভিন্ন জেলার সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। সেই সব জায়গায় উপভাষার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। যে-হেতু বাংলার প্রায় সব উপভাষাকে এই অ্যাপের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে, তাই ভবিষ্যতে প্রতিবেশী দেশটির কথাও আমরা ভাবছি।’’ সৈকতবাবু জানান, প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের সাহায্য করার জন্য বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গড়া হয়েছে। সেই কমিটি নিয়মিত উপভাষা-কেন্দ্রিক যন্ত্রের অনুশীলন পদ্ধতিতে সাহায্য করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা-কেন্দ্রিক একটি প্রযুক্তি-নির্ভর ডিজিটাল মানচিত্র তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে বলে জানান উপাচার্য।