উল্লাস: রাজস্থানে জনসভায় নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার। পিটিআই
আজ হাসতে মানা নেই।
সকাল থেকে যেখানেই যাচ্ছেন, আগের মতো শুনছেন ‘মোদী-মোদী-মোদী’। লোকসভা নির্বাচনের মুখে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে জইশ ঘাঁটি ধ্বংসের দাবি করে নরেন্দ্র মোদীর ‘পাখির চোখ’ ভোট। রাজস্থানের চুরুতে এক সভায় তাই সটান বলেই দিলেন, ‘‘আপনাদের একটি ভোটের শক্তি ২০১৪ সালে দিল্লিতে মজবুত সরকার গড়েছে। আপনাদের মজবুত ভোটের দম দুনিয়া দেখছে। আপনাদের ভোট ‘মজবুর’ আর দুর্বল সরকারের স্বপ্ন দেখা লোকেদের জবাব দেবে। আর আমার বিশ্বাস, আমাকে আর বিজেপিকে আগের থেকে বেশি শক্তি দেবে।”
এমন নয় যে, সেনার পরাক্রম নিয়ে মোদী শব্দ খরচ করেননি। তবে চুরুর বক্তৃতার প্রায় পুরোটাই জুড়ে তিনি নিজে। বলেন, ‘‘দেশ নিরাপদ হাতেই রয়েছে। শপথ নিয়ে বলছি, ভারতকে নত হতে দেবো না।’’ সকালে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠক সেরে রাষ্ট্রপতি ভবনে সামান্য দেরিতে পৌঁছন। ‘অন্য বৈঠকে ব্যস্ত ছিলাম’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তা-ও আবার ‘গাঁধী শান্তি পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে। সেখান থেকেই সোজা রাজস্থানের চুরুতে। ফিরে এসে চাপলেন দিল্লি মেট্রোয়। আমজনতাকে সুযোগ দিলেন সঙ্গে ছবি তোলার। তার পরেই ইস্কনের অনুষ্ঠানে। সেখানে সব থেকে বড় গীতার উদ্বোধন করলেন। ‘শস্ত্র’ ও ‘শাস্ত্রে’ ছেয়ে রইলেন গোটা দিন।
আর মোদীর দলের তরফে সকাল থেকেই সুকৌশলে জানিয়ে দেওয়া হল, এক জন বায়ুসেনার গায়েও আঁচড় পড়বে না, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরে অভিযানে সম্মতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরে কাল রাতভর জেগে পরিস্থিতির উপর নজর রেখেছেন, অভিযান শেষ হওয়ার পরে কথা বলেছেন প্রতিটি মিরাজের চালকের সঙ্গে।
সন্দেহ নেই, ভোটের মুখে বিরোধী জোটের উদ্দীপনাকে কিছুটা পিছনে ঠেলে দিয়েছে নতুন এই পরিস্থিতি। মোদীর নাম না-নিলেও রাহুল গাঁধী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মায়াবতী— বায়ুসেনাকে আজ কুর্নিশ জানালেন সকলেই। মমতার কথায়, ‘‘আইএএফ অলসো মিনস ইন্ডিয়ান আমেজিং ফাইটার্স।’’ ওমর আবদুল্লার টুইটেও কার্যত স্বীকার করা হল, বায়ুসেনার অভিযানের পরে বিষয়টি নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ‘বিদ্রোহী’ শত্রুঘ্ন সিনহা বা বরুণ গাঁধীকেও মোদীর তারিফ করতে হল। সর্বদল বৈঠকের পরে সুষমা স্বরাজ বললেন, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সব দলই সরকারের পদক্ষেপের পাশে। আগামিকাল দিল্লিতে বিরোধীদের যে বৈঠক রয়েছে মোদীর বিরুদ্ধে কৌশল রচনার জন্য, সেখানেও এখন আলোচ্য বিষয় বায়ুসেনার অভিযান পরবর্তী পরিস্থিতি। অর্থাৎ অন্তত এই মূহূর্তে দেশে রাজনৈতিক এবং সাধারণ চর্চার বিষয় স্থির করে দিলেন মোদীই। রাফাল কেলেঙ্কারি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, বেকারত্ব, কৃষক সমস্যাকে আপাতত পিছনে ফেলে দিয়ে।
বিশেষত গত কয়েক মাস ধরে প্রধানত রাহুল যা যা অভিযোগ আনছিলেন, আর সব কিছু ফেলে তার জবাব দিতে হচ্ছিল মোদী এবং বিজেপিকে। পুলওয়ামা কাণ্ডের পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে বিজেপি নেতারাই বলছেন, “ভোট পর্যন্ত এই আবেগকে ধরে রাখাই আসল চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান যদি এ বারে পাল্টা হানা দেয়, তাহলে সুবিধা মোদীরই।”
অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অবশ্য মনে করেন, এমন জিগির সবসময় যে ভোটে ফায়দা দেয়, তা নয়। ’৭১ সালের যুদ্ধের পর ইন্দিরা গাঁধীর প্রবল জনপ্রিয়তা পরবর্তী কালে এমনই কমে যায় যে বিরোধিতা সামলাতে না পেরে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জিতলেও ব্রিটেনে পরবর্তী নির্বাচনে উইনস্টন চার্চিলের দল পরাজিত হয়। জয়ী হয় লেবার পার্টি। কুয়েত যুদ্ধের পর জর্জ বুশ সিনিয়রেরও একই হাল হয়েছিল। তবে এ দেশে ভোটের ঠিক মুখে কার্গিল যুদ্ধের পর ফায়দাই হয়েছিল বাজপেয়ীর।
এবার ‘ব্যাকফুট’ থেকে ফের ‘ফ্রন্টফুটে’ আসার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে সেনাপতি অমিত শাহকে নিয়ে তাই ঘুঁটি সাজাতে নেমে পড়েছেন মোদী। মোদীর কেন্দ্র
বারাণসীতে আজই ছিলেন অমিত। জাতীয়তাবাদের আবেগকে ভোটে রূপান্তরিত করতে ২২ কোটি পরিবারের মন জয়ের চেষ্টা করছেন তিনি। যে পরিবার গত পাঁচ বছরে মোদী সরকারের প্রকল্পের কোনও না কোনও সুফল পেয়েছেন। অঙ্কটি স্পষ্ট। গত লোকসভায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল ১৭ কোটির। ২২ কোটি পরিবারের একটি অংশ ভোটে পেলেও তা ছাপিয়ে যাবে। তাই তিনিও ‘সঙ্কল্প’ নিচ্ছেন, মোদীকে ফের প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। গোটা দলকেও তেমন নির্দেশ।
আর মোদী চুরুর সভায় গিয়ে বললেন, “আজ আপনাদের মেজাজ অন্যরকম মনে হচ্ছে?” সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনি, মোদী-মোদী-মোদী। এটিই শুনতে চাইছিলেন প্রধানমন্ত্রী: “আপনাদের ভাবনা, জোশ খুব ভালো বুঝছি। দেশবাসীকে বিশ্বাস দিতে চাই, দেশ নিরাপদ হাতে।” বলেই দুহাত জুড়ে নমস্কার করলেন। বোঝালেন, এই নিরাপদ হাতটি তাঁর নিজেরই।
এরপরেই আওড়ালেন পুরনো কবিতা, যেটি ২০১৪ সালেও বলেছিলেন, “সৌগন্ধ মুঝে ইস মিট্টি কি, ম্যায় দেশ নেহি মিটনে দুঙ্গা/ ম্যায় দেশ নেহি রুকনে দুঙ্গা/ ম্যায় দেশ নেহি ঝুকনে দুঙ্গা…।” ফের ফিরিয়ে আনলেন নিজের ‘প্রধান সেবক’ তকমা, ‘মোদী বলেই সম্ভব’ স্লোগান। ইসকনে গিয়েও গীতার উপদেশ আওড়ে বললেন, “দুষ্ট আত্মা ও অসুরের থেকে মানবতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।” সে মঞ্চেও উঠল মোদী-মোদী ধ্বনি। হাসিমুখে একটু থেমে মোদী বললেন, “হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ।”