মুম্বইয়ে ইয়াকুব মেমনের বাড়ির সামনে পুলিশি প্রহরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।
রাত তখন আড়াইটে। অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির বাড়িতে টেলিফোন বেজে উঠল। ফোনের উল্টোদিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার, ‘‘স্যার, এখনই আদালতে আসতে হবে। রাত ৩টেয় শুনানি শুরু হচ্ছে।’’ কোনও মতে সাদা জামা, কালো গাউন চাপিয়ে রওনা হলেন রোহতগি।
রাত তিনটে। সুপ্রিম কোর্টের সেই চার নম্বর এজলাস। ফের বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি পি সি পন্থ ও বিচারপতি অমিতাভ রায়ের বেঞ্চ। ঘুম থেকে উঠে তাঁরা চলে এসেছেন। বুধবার বিকেল ৪টেয় এই বেঞ্চই ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি স্থগিতের আর্জি খারিজ করে দিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর মধ্যরাতে প্রধান বিচারপতির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়েন আইনজীবীরা, যদি কোনও ভাবে সাত সকালে নির্ধারিত ফাঁসি আটকানো যায়। প্রধান বিচারপতি শুনানির আর্জি মেনে নেন। তাঁর নির্দেশেই শেষ রাতে সুপ্রিম কোর্টের এজলাস খুলে শুরু হয় সওয়াল-জবাব।
শেষ পর্যন্ত ইয়াকুবের ফাঁসি আটকায়নি। রাত ৩টে ২০ থেকে ভোর ৪টে ৫০ — ৯০ মিনিট শুনানির পর তার শেষ আর্জিও খারিজ হয়ে যায়। তত ক্ষণে নাগপুরের জেলে শুরু হয়ে গিয়েছে ফাঁসির প্রস্তুতি। জন্মদিনের ভোরে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরতে দেওয়া হয় ইয়াকুবকে। সাড়ে ৫টায় তাকে ফাঁসির নির্দেশ পড়ে শোনানো হয়। ভোর সাড়ে ৬টায় ফাঁসির মঞ্চে ওঠে ইয়াকুব। ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে লিভারে টান দেন ফাঁসুড়ে। কোর্টের রায় বেরোনোর পর তখনও পুরো দু’ঘণ্টা কাটেনি। ৭টা ১০-এ জেলের চিকিৎসক পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন ইয়াকুবকে।
মুম্বই বিস্ফোরণের অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগেই অবশ্য দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে ‘নজিরবিহীন’ শুনানি। বিচারপতিদের বাড়িতে রাতে শুনানি আগেও হয়েছে। কিন্তু ফাঁসিতে দণ্ডিত অপরাধীর আর্জি শুনতে শেষ রাতে এজলাস খুলে ভোর পর্যন্ত শুনানি সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে আগে হয়েছে বলে কেউই মনে করতে পারছেন না। কারণ, শুধু বিচারপতি আর আইনজীবীরা হাজির হলেই আদালত বসানো যায় না। এজলাসের কোর্ট মাস্টার, আর্দালি থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষী— সকলকে হাজির করতে হয়। আদালত কক্ষ খুলিয়ে সেটিকে শুনানি শুরুর উপযুক্ত করে তোলা খুব সহজ নয়। গত রাতে এই গোটা কর্মকাণ্ডই হয়েছে অত্যন্ত মসৃণ ভাবে। যা দেখে অ্যাটর্নি জেনারেল নিজেই বলছেন, ‘‘এমন ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম। আমি খুশি যে, সুপ্রিম কোর্ট পরিস্থিতি বিচার করে এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। দেশের সব আদালতের কাছে অনুকরণযোগ্য ঘটনা।’’
প্রবীণ আইনজীবী সোলি সোরাবজি থেকে প্রাক্তন বিচারপতি ফকরুদ্দিন— সকলেই এক সুরে বলছেন, শীর্ষ আদালত গোটা বিশ্বেই এক নতুন মাইলফলক তৈরি করল। সোরাবজির কথায়, ‘‘আমি গর্বিত, দেশে এমন আদালত, এমন বিচারপতি বা আইনজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা মানুষের জীবন বা ন্যায়ের জন্য এত সংবেদনশীল।’’
ভোর রাতের শুনানিতে ইয়াকুবের পক্ষের আইনজীবীদের মূল যুক্তি ছিল, বুধবার রাতে প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার সকালেই কারও ফাঁসি হতে পারে না। মাঝখানে অন্তত ১৪ দিনের ব্যবধান থাকা উচিত। যাতে আসামি মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারে। প্রয়োজনে আইনের বিকল্প রাস্তা খুঁজতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকাতেও সে কথা বলা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের জেলের নিয়মাবলিও বলছে, প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ ও ফাঁসির মধ্যে সাত দিনের ব্যবধান থাকতে হবে।
ইয়াকুবের তরফে আইনজীবী আনন্দ গ্রোভার যুক্তি দেন, গত বছর রাষ্ট্রপতি যে প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন, সেটি ইয়াকুবের তরফে তার ভাই করেছিল। কাজেই, তার পরেও ইয়াকুবের আবেদন করার অধিকার ছিল। বুধবার সকালে সে নিজে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে। গ্রোভার বলেন, সেই আবেদনও যে খারিজ হয়েছে, তা ইয়াকুবকে সবিস্তার জানানো দরকার। তার পরেই সে পুরোপুরি মৃত্যুর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারবে। তা ছাড়া, রাষ্ট্রপতি এত কম সময়ের মধ্যে ইয়াকুবের আবেদন ভাল ভাবে খতিয়ে দেখার সময় পাননি বলেও যুক্তি দেন গ্রোভার।
পাল্টা যুক্তিতে রোহতগি বলেন, গত ৩০ এপ্রিল জারি হওয়া ফাঁসির পরোয়ানার কথা ইয়াকুবকে ১৩ জুলাই জানানো হয়েছিল। তার পরে সে ১৪ দিনের বেশি সময় পেয়েছে। ইয়াকুবের বা তার হয়ে ভাইয়ের প্রাণভিক্ষার আবেদন আলাদা নয়। এই ভাবে কেউ রোজ একের পর এক প্রাণভিক্ষার আর্জি পেশ করে নিয়মের অপব্যবহার করতে থাকলে কাউকে কখনওই ফাঁসি দেওয়া সম্ভব হবে না।
সওয়াল-জবাব শেষে ভোর ৪টে ৫৫ মিনিটে বেঞ্চ রায় দেয়, ‘‘এই ধরনের মামলায় ফাঁসি স্থগিত হলে তা বিচারের পরিহাস হয়ে দাঁড়াবে।’’ বিচারপতিরা জানান, ইয়াকুবের প্রাণভিক্ষার আবেদন গত বছরই রাষ্ট্রপতি খারিজ করে দিয়েছিলেন। তার পরেও সে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। সেই সব প্রক্রিয়াও শেষ হয়ে গিয়েছে। কাজেই ফাঁসি স্থগিতের এই আবেদনের কোনও সারবত্তা নেই। আবেদন খারিজ করে দেওয়া হল।
হতাশ গ্রোভার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে ‘যন্ত্রণাদায়ক ভুল’ বলে মন্তব্য করেন। প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘‘এ কথা ঠিক যে, আর কোনও আইনি পথ খোলা ছিল না। কিন্তু আদালতের রায়ে আমি সন্তুষ্ট নই। আজ সকালেই কি ফাঁসি দেওয়া জরুরি ছিল? এ তো হিংসার বদলে হিংসা। গণতন্ত্রের পক্ষে দুঃখের দিন।’’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান আকর পটেল বলেন, ‘‘খুন করা যে অন্যায়, তা বোঝাতে সরকার আজ একটা লোককে ঠান্ডা মাথায় খুন করল।’’ অ্যাটর্নি জেনারেল রোহতগি অবশ্য এই রায়কে তাঁর ‘জয়’ হিসেবে দেখতে চান না। তিনি বলেন, ‘‘এতে জয় বা আনন্দের কিছু নেই। আমি আমার কর্তব্য করছিলাম। মুম্বই বিস্ফোরণের ক্ষতিগ্রস্তরা সুবিচার পেলেন।’’
কেউ কেউ যদিও প্রশ্ন তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট কি সকলের জন্যই গভীর রাতে দরজা খুলবে? উল্টো দিকে এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে, এ বার থেকে অনেকেই হয়তো মাঝরাতে বিচারপতিদের বাড়িতে হাজির হবেন।
রোহতগির অবশ্য মত হল, এ বারের পরিস্থিতি আলাদা ছিল। এই মামলা অন্য মামলার মতো নয়। তাঁর কথায়, ‘‘সকালে ৭টায় ফাঁসি নির্ধারিত ছিল। মাঝরাতে আবেদন শোনা না হলে তা আর শোনাই হত না।’’ আইনজীবী সোরাবজিও বলছেন, ‘‘বিখ্যাত আইনজীবীরা গিয়েছেন বলেই মাঝরাতে শুনানি হয়েছে— এ কথা বললে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি অবিচার করা হবে। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝেই আদালত মাঝরাতে বসেছে।’’