ভারত ও চিনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা।—ছবি এএফপি।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখায় দু’দেশের সেনা চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘এলওসি’ বা নিয়ন্ত্রণরেখার দু’দিকে একেবারে মুখোমুখি দু’দেশের সেনা চৌকি। সুযোগ পেলেই পাকিস্তানের সেনা গোলাগুলি, মর্টার ছোড়ে। পাল্টা জবাব দেয় ভারতীয় সেনাও।
অন্য দিকে ভারত ও চিনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দু’দেশের বাহিনীর শিবিরের মধ্যে কোথাও কোথাও ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব। দু’দেশের সেনাই ‘এলএসি’ বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় নজরদারি চালায়। কিন্তু কেউই সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে না।
অন্তত এত দিন এমনটাই চলছিল। এ বার চিন ‘এলএসি’-কে ‘এলওসি’-তে পরিণত করতে চাইছে বলে মনে করছেন সেনাকর্তারা। গালওয়ান ঘাঁটি থেকে প্যাংগং লেক— চিন যতটা পর্যন্ত এলাকা নিজেদের বলে মনে করে বা যেটাকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা মনে করে, সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। সেনাকর্তাদের যুক্তি, তার জেরে ভারতের সেনাকেও তার উল্টো দিকে ঘাঁটি গেড়ে পাহারায় বসতে হচ্ছে। যাতে চিন আরও এগোতে না-পারে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “চিন চাইছে, এটাই এখন থেকে স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। কিন্তু আমরা কোনও ভাবেই তা হতে দেব না। দু’দেশের মধ্যে সামরিক স্তরে ও কূটনৈতিক স্তরের বৈঠকে ‘ডিজএনগেজমেন্ট’ বা দুই বাহিনীর পিছু হটার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন দেখার, চিনের সেনা কবে পিছু হটে গিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে যায়। চিনকে বাধ্য করানোটাই চ্যালেঞ্জ।”
আরও পড়ুন: মুখে নেই চিন-নাম, ‘দখল’ নিয়ে নীরব, প্রধানমন্ত্রীর জবাবে প্রশ্ন
চিনের সঙ্গে এলএসি কোনও মানচিত্রে আঁকা নেই। জমিতেও চিহ্নিত করা নেই। দু’দেশ নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী চলে। এ নিয়ে যাতে রোজ যাতে সংঘর্ষ না-বাধে, সেই জন্যই কেউ এত দিন এলএসি-তে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসত না। মাঝখানে ব্যবধান রেখে চলত। এখন ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ কার্যত ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের সঙ্গে এলওসি ও চিনের সঙ্গে এলএসি-র মধ্যে ফারাক থাকছে না।
কিন্তু কেন চিনের সেনা একেবারে এলএসি-তেই এসে ঘাঁটি গাড়ছে? সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গালওয়ান ভ্যালিতে চিন এমন জায়গাকে এলএসি বলে ঘাঁটি গাড়ছে, যেখান থেকে তারা ভারতের দৌলত বেগ ওল্ডি সড়কের উপরে নজর রাখতে পারে। প্যাংগং লেকে তারা ফিঙ্গার-ফোরের এমন জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছে, যাতে ভারত ফিঙ্গার-এইট পর্যন্ত যেতে না পারে। একই ভাবে দেপসাং ভ্যালিতে চিন এলএসি পেরিয়ে দেড় কিলোমিটার ঢুকে ওয়াই-জংশন বলে চিহ্নিত এলাকা পর্যন্ত চলে এসেছে, যাতে ভারতীয় জওয়ানরা ১০ বা ১৩ নম্বর পেট্রোলিং পয়েন্টে যেতে না পারে। ১৫ জুন চিনের সেনাকে সেখান থেকে ‘পুশ ব্যাক’ করা হলেও ফের তারা সমঝোতা ভেঙে ফিরে এসেছে। কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি বলেন, “চিনের কাছে ডিজএনগেজমেন্ট-এর অর্থ হল, তোমরা পিছু হঠো। আমরা সরব না। প্রশ্ন হল, মোদী সরকার কী ভাবছে?” সেনা-কর্তারাও মানছেন, চিন গালওয়ান, প্যাংগং লেকের সঙ্গে দেপসাং, চুমার, ডেমচক, গোগরা-তেও এলএসি-র ছবি বদলাতে চাইছে।
আরও পড়ুন: জোড়া নির্দেশ কাশ্মীরে, তুঙ্গে জল্পনা
এই পিছু হঠার প্রশ্নে চিনের মুখের কথায় ও কাজে ফারাকের কারণে লাদাখে এলএসি কার্যত এলওসি-র চেহারা নিয়েছে। দুই বাহিনীই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পাশে বিপুল সেনা মোতায়েন করেছে। রবিবার সেনাবাহিনী, আইটিবিপি-র কর্তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। শুধু লাদাখেই ভারতের সেনা মোতায়েন দ্বিগুণ হয়েছে। এখন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার সেনা রয়েছে।
আইটিবিপি-ও শক্তি বাড়িয়েছে। উল্টো দিকে চিনও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। প্যাংগং লেকের উত্তরেও চিন হাজার দেড়েক সেনা এনে কংক্রিটের বাঙ্কার তৈরি করে ফেলেছে। সেনার নর্দান কমান্ডের প্রাক্তন প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনান্ট জেনারেল দীপেন্দ্র সিংহ হুডা তাই সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, “সত্যি কথা বললে, চিন প্যাংগং লেকের উত্তরে জোর করে এলএসি বদলে ফেলেছে। নিজেদের ধারণা অনুযায়ী চৌকি তৈরি করেছে। সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, চিনকে আগের অবস্থানে ফিরতে বাধ্য করা।”