লাদাখে ভারতীয় সেনাবাহিনী।—ছবি এপি।
লাদাখে চিনের সেনার হাতে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু এবং ১০ জন সেনাকে চিন তিন দিন বন্দি করে রাখার পরে প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদী সরকার কি বেজিংয়ের সামনে আত্মসমর্পণ করে ফেলল! রাহুল গাঁধী আজ নরেন্দ্র মোদীকে ‘সারেন্ডার মোদী’ বলে তকমাও দিলেন। এই পরিস্থিতিতে এ বার মোদী সরকার দাবি করল, গত সোমবার রাতের সংঘর্ষের পরে চিনের সেনারাও ভারতের হেফাজতে ছিল।
প্রাক্তন সেনাপ্রধান, বর্তমানে মোদী সরকারের সড়ক প্রতিমন্ত্রী জেনারেল ভি কে সিংহের দাবি, ‘‘যখন মারামারি হয়, তখন আমাদের কয়েক জন অন্ধকারের মধ্যে ওদের এলাকায় চলে যান। ওদের কয়েক জন আমাদের দিকে চলে আসেন। সংবাদমাধ্যমে খবর হচ্ছে, আমাদের এত লোককে ওরা আটকে রেখেছিল, তার পরে ছেড়ে দিয়েছে, তা হলে একই ভাবে আমরাও ওদের লোকদের ছেড়ে দিয়েছি। এখানে কাউকে কয়েদ করে রাখার বিষয় নেই।’’ সরকারের একটি সূত্রের দাবি, চিনের অন্তত ১৫ জন ফৌজি ভারতের হেফাজতে ছিল। শুধু তাই নয়, ভি কে সিংহ জানিয়েছেন, ভারতের ২০ জন মারা গেলে, চিনের দিকেও তার দ্বিগুণের বেশি জওয়ান মারা গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘৪৩ জনের হিসেব দেওয়া হয়েছে। এদের আমাদের সেনারা পড়ে থাকতে দেখেছে। এর বাইরেও কত জন ঘায়েল হয়েছেন, তা কেউ জানে না।’’
ভি কে-র এই দাবির পরে প্রশ্ন উঠেছে, এই তথ্য সরকার আগে জানায়নি কেন? সোমবার রাতে সংঘর্ষে ২০ জন সেনার মৃত্যুর পরেই প্রশ্ন উঠেছিল, সেনার কোনও জওয়ানকে চিন আটকে রেখেছে কি না! তিন দিন পরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী জানায়, ভারতের কোনও জওয়ান নিখোঁজ নন। পরে জানা যায়, ওই দিনই বিকেলে অফিসার-জওয়ান মিলিয়ে ১০ জন সেনাকে চিন মুক্তি দেয়। তিন দিন আটকে রাখার পর।
আজ ভি কে সিংহের এই মন্তব্যের পরে কংগ্রেস ফের সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী সে-দিন দাবি করেছিলেন, কেউ ভারতের এলাকায় ঢোকেনি। কেউ ভারতের এলাকা দখল করে বসে নেই। রাহুল গাঁধীর যুক্তি, ‘‘স্যাটেলাইট ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, চিন প্যাংগং লেকের পাশে ভারতমাতার পবিত্র জমি দখল করে ফেলেছে।’’ রাহুল আজ নরেন্দ্র মোদীকে ‘Surender’ (তিনি এই বানানই লিখেছেন, কংগ্রেসের মতে নরেন্দ্রের সঙ্গে মিলিয়ে) বা ‘সারেন্ডার মোদী’ বলে তকমা দেওয়ার পরে বিজেপি সাংসদ মীনাক্ষী লেখি অভিযোগ তুলেছেন, তিনি চিনের হয়ে প্রচার করছেন। বিজেপি সভাপতি আবার ‘Surender’-কে সুরেন্দ্র উচ্চারণ করে বলেছেন, রাহুল নিজেই মেনে নিচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী শুধু নরেন্দ্র বা মানুষের রাজা নন, তিনি সুরেন্দ্র বা দেবতাদেরও রাজা।
তবে প্রাক্তন সেনাকর্তাদের একাংশও বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর দাবিমতো চিন ভারতের এলাকায় না-ঢুকলে ২০ জন জওয়ান মারা গেলেন কী করে? ১০ জনকে ওরা বন্দি করল কী করে? তাঁদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে অস্ত্র করে এখন চিন বলছে, গোটা এলাকাই তাদের দখলে। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য সেই দাবিতেই সিলমোহর বসিয়েছে। না হলে সরকারকে মানতে হবে, ভারতের সেনা চিনের এলাকায় ঢুকেছিল।
ভি কে সিংহের দাবি, চিনের সেনারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর নিজের এলাকায় ছিল। ভারতের জওয়ানরাও নিজের এলাকায় ছিল। তবে চিন গালওয়ান ঘাঁটির ১৪ নম্বর পেট্রলিং পয়েন্ট এলাকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে আসতে চাইছিল। যাতে সেখান থেকে দারবুক-শিয়ক-দৌলত বেগ ওল্ডির রাস্তায় নজর রাখতে পারে। কিন্তু তাদের বাধা দেওয়া হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল-স্তরের বৈঠকে ঠিক হয়, দুই বাহিনীই পিছনে হঠে যাবে। চিন জানায়, তারা দেখতে চায়, ভারত সরছে কি না। সে কারণে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে তাদের একটি তাঁবু রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সোমবার বিকেলের পরেও সেই তাঁবু সরেনি। কর্ণেল বি সন্তোষ বাবুর নেতৃত্বে একটি বাহিনী সেখানে যায়। তার পরেই সংঘর্ষ বাধে। দুই দিক থেকেই আরও বাহিনী পাঠানো হয়। রাতের অন্ধকারে ১৬ হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের মাথায় দু’দিকের প্রায় ৬০০ জন জড়ো হয়ে যান। ঘুষোঘুষির মধ্যে কেউ নীচে শিয়ক নদীতে পড়ে যান। ভিড়ের চাপে কিছু জায়গায় মাটিও সরে গিয়ে ধস নামে। তাতেও অনেকে খাদে গড়িয়ে পড়েন। সরকারি সূত্রের খবর, সন্ধ্যায় কর্নেল সন্তোষ বাবুর নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর পরে তিন দফায় দুই বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। কিন্তু তিনি কোনও কোম্পানি কমান্ডার বা মেজরকে না পাঠিয়ে নিজেই কেন গেলেন, সে প্রশ্ন উঠছে।