নরেন্দ্র মোদীর রণকৌশলের কাছে কংগ্রেস নেতৃত্ব যে বারবার পরাস্ত হচ্ছেন, সে কথা এ বার সনিয়া গাঁধী নিজেই স্বীকার করছেন। লোকসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে বিধানসভা নির্বাচনগুলিতেও পর্যুদস্ত হওয়ার পর অবশেষে কংগ্রেস হাইকমান্ড নিজেদের খামতি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করেছেন।
লোকসভা নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ার পরেও গত পাঁচ মাসে কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার তেমন পরিচয় পাওয়া যায়নি। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনেও যে ভাবে ব্র্যান্ড মোদী কাজ করেছে, তার মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে রাহুল গাঁধীকে কার্যত দেখাই যায়নি। লোকসভা নির্বাচনের ভ্রান্তি শুধরে নিয়ে কংগ্রেস পাল্টা রণকৌশল তৈরি করতে পারেনি।
এ বার কিন্তু ১০ নম্বর জনপথে বসে সনিয়া নিজেই আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। প্রচারকৌশলের দৌড়ে কংগ্রেসের তুলনায় মোদী কতখানি পেশাদার ও আক্রমণাত্মক, সেটা সনিয়া-রাহুল দু’জনেই এখন সম্যক বুঝতে পারছেন। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ভোটের সময় আমরা মোদী এবং তাঁর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে প্রচারেই ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, কৌশলে মোদী কত আক্রমণাত্মক ছিলেন।”
বিশেষ করে একটি ঘটনা সম্প্রতি কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের চোখ খুলে দিয়েছে। লোকসভা ভোটের এক বছর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জে কর্মরত প্রশান্ত কিশোর নামের এক যুবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাহুল গাঁধীর কাছে আসেন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ তিনি। রাহুল গাঁধীর প্রচার, ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রশান্তের সঙ্গে কথা বলে খুবই সন্তুষ্ট হন রাহুল। তাঁর জন্য মোটা পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা হয়। প্রশান্ত অমেঠি ও রায়বরেলী যাওয়া শুরু করেন।
এই অবধি ভালই চলছিল। কিন্তু হাতেকলমে কাজ করার সময় যেই এল, পদে পদে বাধা পেলেন প্রশান্ত। প্রবীণ নেতারা এই আধুনিক প্রচারকৌশলকে অবান্তর-অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করছিলেন। অন্য দিকে প্রশান্ত নিজে তাঁর ফিডব্যাক রাহুলকে দেওয়ার সুযোগই পাননি। প্রতি সপ্তাহে তাঁর রিপোর্ট রাহুলকে দেখানোর জন্য দিল্লি আসতেন। কিন্তু দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও তিনি রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে পাননি। কিছুদিন পর কিঞ্চিত্ বিরক্ত হয়েই প্রশান্ত আমেরিকা ফিরে যান এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কাজে মনোনিবেশ করেন।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদীর কানে নানা সূত্রে প্রশান্ত কিশোরের খবর যায়। তিনি ওই যুবককে গাঁধীনগরে ডেকে পাঠান। প্রশান্ত তখন ফের কংগ্রেস নেতাদের কাছে বার্তা পাঠান যে, মোদী তাঁকে ডাকছেন। কিন্তু তখনও রাহুল কোনও ব্যবস্থা নেননি। প্রশান্ত অতএব মোদীর সঙ্গে দেখা করেন। যে পারিশ্রমিক রাহুল তাঁকে দিতেন, তার দ্বিগুণ মূল্য দিতে প্রস্তুত হন মোদী। সেই সঙ্গে তিনি আরও যেটা দেন, সেটা সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ। মোদীর ব্র্যান্ডিং এবং মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়া পরিচালনার জন্য নতুন গবেষক দল তৈরি করে প্রশান্ত ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফল সবার জানা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও মোদীর মার্কিন সফরে বিপুল কর্মযজ্ঞের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন এই প্রশান্তই। মোদীর পাশে তাঁকে সব সময় দেখা গিয়েছে নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটনে। বিধানসভা নির্বাচনেও ব্র্যান্ড মোদীর প্রচার এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এই প্রশান্তই। বিজ্ঞাপন বাবদ এ বার ২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে বিজেপি। দেশের প্রথম সারির বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলির তত্পরতায় ‘অব কি বার মোদী সরকারে’র স্লোগান বদলে গিয়েছে ‘চলো চলে মোদীকে সাথ’-এ।
এই ঘটনাটি নিয়েই এখন কংগ্রেস শিবিরে জোর আলোচনা। কেউ কেউ এর জন্য রাহুল গাঁধীর ব্যক্তিগত সচিব কণিষ্ককে দায়ী করছেন। তাঁকে সরানোর দাবি উঠেছে। অনেকে আবার বলছেন, রাহুলকে বাদ দিয়ে শুধু কণিষ্ককে দোষী সাব্যস্ত করাটা অনৈতিক। কিন্তু ঘটনা হল, আধুনিক প্রজন্মের ভাষায় কথা বলা, তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করার কথা রাহুলই কিন্তু সবার আগে বলেছিলেন। তার জন্য নতুন গবেষক টিম তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই রাহুলই পাঁচ বছর আগে বিহার বিধানসভা নির্বাচনের সময় ‘একলা চলো রে’ নীতি নিতে চেয়েছিলেন। পাঁচমড়ী অধিবেশনে জোট রাজনীতির রণকৌশল বদলাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু বাস্তব বলছে, চিন্তার সফল প্রয়োগে কংগ্রেস যতটা ব্যর্থ, ততটাই সফল মোদী। রাহুলের ‘একলা চলো’ ছিনিয়ে নিয়েই মোদী-অমিত শাহ জুটি সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে ঝড় তুলেছেন। আর, আধুনিক প্রচারকৌশল ব্যবহারের দিক দিয়ে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে মোদী রীতিমতো যুগান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন।
এখন সঙ্কটের মুখে কংগ্রেসে যেমন আত্মসমীক্ষার পালা চলছে, তেমনই নেতৃত্বের পরিবর্তন চাওয়ার দাবিও জোরালো হচ্ছে। এবং রাহুলের বিরুদ্ধে দল পাকাচ্ছেন সেই বৃদ্ধরাই। সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব অহমেদ পটেল ও জনার্দন দ্বিবেদীর মধ্যে একদা অনেক মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু এখন এই দুই নেতা অনেক কাছাকাছি। এমনকী দিগ্বিজয় সিংহের মতো রাহুলের স্বঘোষিত অভিভাবকও এই ক্লাবের সদস্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। রাহুল-ঘনিষ্ঠ এক নেতার যদিও দাবি, রাহুলই দিগ্বিজয়কে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এই প্রবীণ নেতারা কেউ কেউ প্রিয়ঙ্কা গাঁধীকে নিয়ে আসার দাবি তুলছেন। বাকিরা পরিবারতন্ত্রের বদলে সম্মিলিত নেতৃত্বের জন্য সওয়াল করছেন। এঁদের মতে, এখন ভোট নেই। কাজেই দলীয় সংগঠনকে ঢেলে সাজার জন্য রথের রশি আবার প্রবীণদের হাতেই তুলে দেওয়া প্রয়োজন।
রাহুল ঘনিষ্ঠরা কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সম্মিলিত নেতৃত্বের কথাও রাহুলই প্রথম বলেছিলেন। এমনকী কংগ্রেসের প্রার্থী পদের নির্বাচন মার্কিন স্টাইলে প্রাইমারি পদ্ধতি চালু করতে চেয়েছিলেন। তখন এ সবের বিরোধিতা করেছিলেন প্রবীণরাই। তাঁরাই আধুনিক প্রচারকৌশলকে খাটো করে দেখেছিলেন। এখন বিপর্যয়ের পরে যদি প্রবীণরাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাতে কি সমস্যা মিটবে? ব্র্যান্ড মোদীকে মোকাবিলার জন্য সাবেকি পদ্ধতি অবলম্বন করলে কি চলবে? কংগ্রেসে এখন যে পেশাদারি আধুনিকমনস্কতা প্রয়োজন, সেটা কি বৃদ্ধেরা আনতে পারবেন? সব মিলিয়ে চূড়ান্ত টানাপোড়েনে কংগ্রেস সম্পূর্ণ দিশাহীন।
শীর্ষ নেতারা অবশ্য একটা ব্যাপারে একমত— সনিয়া গাঁধীর আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সনিয়া নিজে এখনই খুব সক্রিয় হতে চাইছেন না। বরং তিনি আপাতত চুপচাপ সব কিছুর উপরে তীক্ষ্ন নজর রাখতে বেশি আগ্রহী। দলের মুখপাত্র অজয় মাকেন বলছেন, ত্রুটিবিচ্যুতি তো আছেই। কিন্তু এই পরিস্থিতি এক দিন কেটেও যাবে। এক মাঘে কি শীত যায়?