রামলালার সামনে প্রার্থনা নরেন্দ্র মোদীর। ছবি: পিটিআই
সরযূকে ক্ষীণকায়া বলেই জানা ছিল এত দিন। প্রখ্যাত নদী, হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী পবিত্র নদী, তবে প্রবাহ ক্ষীণ— এমনই ধারণা ছিল। কিন্তু সরযূর যে শ্রাবণী চেহারা এ বার অযোধ্যায় আসা ইস্তক দেখা যাচ্ছে, সেই প্রকাণ্ড প্রবাহকে দেখলে ভয়ই লাগবে। প্রশস্ত জলরাশি, বিপুলা, খরস্রোতা। যেন অর্গলহীন, যেন যে কোনও মুহূর্তে দু’কূল ছাপাতে প্রস্তুত।
সরযূতীরের নগরীতে বুধবার নরেন্দ্র মোদীকেও যেন ওই রকম এক চেহারায় দেখা গেল, যেন আচমকা এক অন্য কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বহু দিন পরে আবার যেন অর্গলহীন হিন্দুত্বে ফিরলেন মোদী।
সঙ্ঘের প্রচারক নরেন্দ্র মোদী যে কট্টর হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’, বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদী যে ‘হিন্দুকুলতিলক’ হিসেবে বিবেচিত, সে কথা এ ভারতভূমিতে কারও অজানা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সাল থেকে নিজেকে অন্য আলোকে চিনিয়েছিলেন। হিন্দুত্বের পথ থেকে সরে গিয়েছিলেন, এমন নয়। কিন্তু হিন্দুত্বের প্রকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতে হিন্দুত্বের প্রবাহটা যেন ক্ষীণকায়া হয়ে গিয়েছিল। বুধবার রাম মন্দির পুনর্নির্মাণের জন্য ভূমিপূজন সেরে রামজন্মভূমিতে দাঁড়িয়ে যে ভাষণ দিলেন মোদী, তাতে আবার সেই পুরনো কণ্ঠস্বর ফিরল। আবার যেন উত্তুঙ্গ হিন্দুত্বে সওয়ার হলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
হনুমান গঢ়ী থেকে বেরোচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। সঙ্গে যোগী আদিত্যনাথ। ছবি: পিটিআই
আরও পড়ুন: ‘রামজন্মভূমি মুক্ত হল’, ১৫ অগস্টের সঙ্গে তুলনা টানলেন মোদী
২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক নরেন্দ্র মোদীকে দেখেছে ভারত। সে মোদী জাতীয়তাবাদের কথা বলছিলেন বটে, কিন্তু হিন্দুত্বের উচ্চারণগুলো উহ্য রাখছিলেন। সরকার পরিচালনার দিশাতেও হিন্দুত্বের রূপায়ণ কম, ‘বিকাশ’ সংক্রান্ত চর্চা বেশি ছিল। প্রধানমন্ত্রী পদে বসেছেন, সুতরাং আপাত ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তত ধরে রাখতেই হবে ভাবমূর্তিতে— মোদী এমনই ভাবছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা ছিল। ২০১৯ সালের পর থেকে আবার কিন্তু পুরনো মোদী ফিরতে শুরু করেন। জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০-এর আচমকা বিলোপ হোক, তিন তালাক ইস্যু হোক, রামমন্দির বিতর্ক হোক— একের পর এক ইস্যুতে মোদী সরকারের অবস্থান কট্টরবাদের ছাপ ক্রমশ স্পষ্টতর করে তুলছিল। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি সামনে আসার পরে আরও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সঙ্ঘের নানা কর্মসূচিরই রূপায়ণ ঘটাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বুধবার অযোধ্যায় মোদীর ভাষণে সেই সঙ্ঘবাদ সম্ভবত শিখর ছুঁয়ে ফেলল।
মন্দিরের শিলান্যাস করছেন নরেন্দ্র মোদী। সঙ্গে যোগী আদিত্যনাথ এবং মোহন ভাগবত। ছবি: পিটিআই
এত দিনে রামজন্মভূমির মুক্তি ঘটল— নিজের ভাষণে বললেন মোদী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথায়, ‘‘বহু দিনের প্রতীক্ষা শেষ। এত দিন তাঁবুতে মাথা গুঁজে ছিলেন রামলালা। এ বার তাঁর জন্য সুবিশাল মন্দির নির্মিত হবে। বহু শতক ধরে যে ভাঙা-গড়ার খেলা চলে আসছে, আজ রামজন্মভূমি তা থেকে মুক্ত হল। সরযূ নদীর তীরে সূচনা হল স্বর্ণযুগের।’’নরেন্দ্র মোদীরা যে ঘরানার রাজনীতি করে এসেছেন, যে রাজনৈতিক দীক্ষায় বিশ্বাস রেখে এসেছেন, তাতে রামজন্মভূমিতে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা করে এই মন্তব্য করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে প্রথম পাঁচটা বছর অন্তত কট্টর হিন্দুত্বের এই স্পষ্ট উচ্চারণ এড়িয়ে চলছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে গেরুয়া বসন পরে কেদারনাথের পাহাড়ি গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়ার ছবি যে হিন্দু ভাবাবেগে নাড়া দেওয়ার জন্যই ছিল, তা ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বিজেপি নেতারাও অস্বীকার করেন না। কিন্তু ধ্যানমগ্ন ছবিটার মতো সে হিন্দুত্বও ছিল ধ্যানমগ্ন, সমাহিত। অযোধ্যায় ভূমিপূজনের মঞ্চে যে নরেন্দ্র মোদীকে দেখা গেল, তাঁর হিন্দুত্বটা সমাহিত নয়, তাঁরটা স্পষ্ট ভাবে ঘোষিত।
আরও পড়ুন: নবযুগের শুরু, বললেন মোহন ভাগবত, রুপোর ইট গেঁথে সূচনা রামমন্দিরের
এ দিনের ভাষণে হিন্দুত্ব আর ভারতের জাতীয়তাকে বার বার মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন নরেন্দ্র মোদী। হিন্দুত্বই হল ভারতের জাতীয়তা, হিন্দুত্বেই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির শিকড়, হিন্দুত্বের উদ্যাপনেই ভারতীয় জাতি প্রেরণা পায়— মোদীর ভাষণের সারকথা ছিল এই। বোলো জয় সিয়াবর রামচন্দ্র কি জয়— এই স্লোগানে শুরু হল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। রামচন্দ্রের এই মন্দিরকে ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবোধের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করতে করতে মাঝপথে যখন নিজেই কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন, তখন ফের এক বার সবাইকে স্লোগানে গলা মেলাতে বললেন— জয় শ্রীরাম। ভাষণ শেষও করলেন রাম-সীতার নামে সমবেত জয়ধ্বনি তুলিয়ে। এই নরেন্দ্র মোদীকে বহু বছর নির্বাচনী জনসভাতেও দেখেনি ভারত।
ভূমিপুজোয় ব্যস্ত নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
নরেন্দ্র মোদীর কথায়, ‘‘এই রামমন্দির আমাদের সংস্কৃতির আধুনিক প্রতীক। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতীক।’’ তার পরে বললেন, ‘আধুনিক’ শব্দটা তিনি ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করছেন। বললেন, ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই রামমন্দিরকে দেখে প্রেরণা পাবে, সংকল্পবদ্ধ হতে পারবে। কিসের প্রেরণা, কোন লক্ষ্যে পৌঁছনোর সঙ্কল্প— ভেঙে বলেননি প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রাম মন্দির পুনর্নির্মাণের লক্ষ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে পূরণ হওয়া মাত্রই হিন্দুত্বের স্বরকে যে পরবর্তী ধাপে পৌঁছে দিলেন মোদী, তা বুঝে নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অসুবিধা হয়নি। যে কথা এত দিন ঈষৎ রেখেঢেকে, ঈষৎ জল মেপে বলা হত, হিন্দুরাষ্ট্রের সেই সঙ্ঘীত স্বপ্নের বীজ যে এ বার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আরও খোলাখুলি বপন করা শুরু হবে, তা সম্ভবত মোদীর এ দিনের ভাষণে পরিষ্কার হয়ে গেল।
এ দিনের মঞ্চে হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’ হিসেবে শুধু নরেন্দ্র মোদী ছিলেন, তা কিন্তু নয়। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবৎ ছিলেন, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ছিলেন। মোদীর মতো এঁরা দু’জনেও সুবক্তা হিসেবে খ্যাতিমান। কিন্তু ভারতের জাতীয়তা বোধ আর হিন্দুত্বকে অঙ্গাঙ্গী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে করলেন এ দিন, তাতে বাকিদের ভাষণ ম্লানই রয়ে গেল। পাঁচ অগস্টকে ১৫ অগস্টের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হিসাবে যখন ব্যাখ্যা করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন অন্তর্নিহিত বার্তাটা সম্পর্কে আর কোনও সংশয়ই রইল না। রাম মন্দির থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা এক বামপন্থী চিন্তাবিদ বলছেন, ‘‘এটাও সুচিন্তিত নকশারই অঙ্গ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রধান বা ঘোষিত হিন্দু সন্ন্যাসীকে দিয়ে ও সব কথা বলানোর তাৎপর্য কম। তাই স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে কথাগুলো বলানো হল এ বার।’’ অন্য বিশ্লেষকদের সুরেই এই বামপন্থী চিন্তাবিদেরও মত, ‘‘নতুন যুগের সূচনা হয়ে গেল ভারতীয় রাজনীতিতে। এ বার পরের ধাপের হিন্দুত্ব দেখার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’’
টিভিতে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের সম্প্রচার দেখছেন নরেন্দ্র মোদীর মা। ছবি: পিটিআই
আরও পড়ুন: রামমন্দিরে চাপা পড়ল ৩৭০ বিলোপের বর্ষপূর্তি, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় উপত্যকা
এ দিনের কর্মসূচি, তাতে নরেন্দ্র মোদীর অংশগ্রহণ এবং তাঁর ভাষণকে যে সকলে সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই দেখছেন অযোধ্যা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায়, তা কিন্তু নয়। বরং সে সংখ্যাটা কমই। গোটা অযোধ্যায় লাগানো হয়েছিল মাইকের চোঙা। শহরের যে কোনও প্রান্তে বসে লাইভ শোনা যাচ্ছিল ভূমিপূজন ও শিলান্যাস কর্মসূচির প্রতিটি পর্ব। মন্দিরে মন্ত্রোচ্চারণ থেকে শুরু করে পুজাপাঠ শেষে অতিথিদের ভাষণ— সব কিছু শোনা যাচ্ছিল রামের গোটা নগরী জুড়ে। টেলিভিশনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্প্রচারের ব্যবস্থা ছিলই। ফলে ঘরে বসেই অযোধ্যাবাসীর পক্ষে সব দেখা বা শোনা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকে আরও একটা বাঁকের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া এই ‘আধ্যাত্মিক’ কর্মসূচি যে কত বড় মাইলফলক, তা বোঝানোর তাগিদও ছিল। অযোধ্যা জুড়ে সর্বপ্লাবী আবহ তৈরি করার পরিকল্পনাও ছিল। অতএব মাইকে সম্প্রচার হল গোটা অনুষ্ঠান। পথেঘাটে উৎসাহ নিয়ে অনেকেই কানও রাখলেন সে দিকে।
এ দিনের কর্মসূচি ঘিরে অযোধ্যায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ছিল না, এমনটা বলা কঠিন। রাম কি পৈড়ীতে উৎসব চলছে সোমবার থেকেই। আর গোটা দেশ থেকে অযোধ্যায় জড়ো হওয়া সংবাদমাধ্যমের এ দিনের রাজধানীও হয়ে উঠেছিল এই রাম কি পৈড়ী-ই। কোনও মঞ্চে তাত্ত্বিক তর্ক চলেছে, কোনও মঞ্চে ভজন। কিন্তু মিডিয়া একা নয়, চড়া রোদ মাথায় নিয়ে সরযূর সেই ঘাটে বসে থাকার বিন্দুমাত্র বাধ্যবাধকতা যাঁদের ছিল না, সেই সাধারণ অযোধ্যাবাসীকেও ওই সবের মাঝে মেতে থাকতে দেখা গিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভজনের সুরে মাতোয়ারা হয়ে ভবঘুরে চেহারার বৃদ্ধা ডাফলি বাজাতে বাজাতে নাচতে শুরু করেছেন কখনও। আবার কখনও যোগী আদিত্যনাথ সম্পর্কে কটাক্ষ শুনে রেগে আগুন হয়েছেন প্রৌঢ় অযোধ্যাবাসী। ‘‘আদালত যে দিন রামজন্মভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করার রায় দিয়েছিল, সে দিন কেঁদে ফেলেছিলেন যোগীজি। আজ অখণ্ড জমিতেই রামমন্দির নির্মাণ হচ্ছে, আর যোগীজির মুখ্যমন্ত্রিত্বেই হচ্ছে। পুণ্যবান না হলে এটা হয় না।’’ বলতে বলতে চোখে জল এসেছে তাঁর। আর বাংলা থেকে আসা সাংবাদিকের কাছে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক বলতে শুরু করেছেন, ‘‘এখানে রামনামের মাহাত্ম্যই এমন... চাহ কর ভি পয়ের নহি থামতি, চাহ কর ভি আঁসু নহি রুকতি।’’
মন্দিরের প্রতিকৃতি হাতে ভক্তরা। ছবি: পিটিআই
এই ভারতকে খুব ভাল ভাবে চেনেন বলেই সম্ভবত পরবর্তী ধাপের হিন্দুত্বের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। এই ভারতের নাড়ি অভ্রান্ত বোঝেন বলেই বোধ হয় কোনও বিশেষ সন্ধিক্ষণে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের ছবি বার বার পাইয়ে দেন তিনি।
জীবনে প্রথম বার লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ার পরে সংসদ ভবনে যে দিন প্রথম পা রেখেছিলেন সদ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া নরেন্দ্র মোদী, সে দিনও দরজার সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে প্রণাম করেছিলেন গণতন্ত্রের বৃহত্তম মন্দিরকে। ছবি দেখে আবেগে ভেসে জয়ধ্বনি শুরু করেছিলেন অনেকেই। বছর ছয়েকের ব্যবধানে আরও একবার সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের ছবি। এ বার রামজন্মভূমিতে, রামলালার বিগ্রহের সামনে। প্রথম বার লোকসভায় ঢোকার সময়ে পরণে ছিল কুর্তা-পাজামা। আর ২৯ বছর পরে অযোধ্যায় ফিরলেন যখন, তখন পরণে সোনালি পাঞ্জাবি, ঘি রঙা ধুতি, গেরুয়া উত্তরীয়।
আলোর মালায় সেজেছে অযোধ্যা। ছবি: পিটিআই
এই ছবিও কি আরও এক সন্ধিক্ষণের সঙ্কেত বহন করছে তা হলে? গণতন্ত্রের পূজারী থেকে এ বার রামলালার পূজারীতে ‘উত্তরণ’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর? ভাষণের দেওয়া ইঙ্গিত কিন্তু তেমনই।