এখানেই চার অভিযুক্তকে এনকাউন্টার করা হয়।
এনকাউন্টার। এই শব্দটিকে ঘিরেই শুক্রবার দিনভর বিতর্ক চলল সমাজমাধ্যমে।
এ দিন সাতসকালেই জানা যায়, হায়দরাবাদে গণধর্ষণের ঘটনায় চার অভিযুক্ত পুলিশের সঙ্গে ‘এনকাউন্টারে’ মারা গিয়েছে। তখন থেকেই টুইট ট্রেন্ডিংয়ে শীর্ষে চলে যায় #এনকাউন্টার। ফেসবুক-টুইটারে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়োয় দেখা যায়, স্থানীয় মহিলারা পুলিশের উদ্দেশে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফুলের পাপড়ি। সমাজমাধ্যমেও অজস্র মানুষ পুলিশকে সমর্থন করে পোস্ট দেন, প্রদীপের ‘অ্যানিমেশন’ দিয়ে। দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার সঞ্জীবকুমার যাদব টুইটারে হায়দরাবাদ পুলিশকে অভিনন্দন জানান। পুলিশকে ‘স্যালুট’ জানান হায়দরাবাদের বাসিন্দা, ব্যাডমিন্টন তারকা সাইনা নেহওয়ালও।
ভার্চুয়াল জনআদালতে এই উল্লাস দেখে এক জন লেখেন, যে পুলিশ ডায়েরি নিতেই অস্বীকার করেছিল, এনকাউন্টার করে কি তা ঢাকা যাবে? আর এক জন লেখেন, এনকাউন্টারকে ‘শাস্তি’ হিসেবে দেখলে তো ধর্ষণে প্রভাবশালী অভিযুক্তদেরও একই শাস্তি প্রাপ্র্য। ওঠে এ ধরনের মামলায় অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের প্রসঙ্গ। হায়দরাবাদেরই বাসিন্দা, আর এক ব্যাডমিন্টন তারকা জ্বালা গুট্টা টুইট করেন, “এই ঘটনা কি ভবিষ্যৎ ধর্ষকদের থামাবে? প্রত্যেক ধর্ষকের বিরুদ্ধেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে? তাদের সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন…?” সৌদি আরবে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেখে জনতার উল্লাসের তুলনা টেনে অনেকে বলেন, ‘‘যাঁরা আজ আনন্দ করছেন, ভেবে দেখুন, যখন পুলিশ আপনাকে যে কোনও অভিযোগে তুলে নিয়ে যাবে, তখন?’’
সিনেমার পর্দায় এমন ‘বিচারের’ বাহুল্য জনমানসে ন্যায়বিচারের এই ধারণাকে জোরালো করেছে বলে মনে করছেন সমাজতত্ত্ববিদেরা। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয় ‘বাহুবলী’ ছবির দৃশ্য। যেখানে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনে অভিযুক্ত এক জনকে রাজসভায় গলা কেটে সাজা দিচ্ছে বাহুবলী। হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়েছে ‘গঙ্গাজল’ ছবির দৃশ্য, যেখানে অজয় দেবগণ বলছেন, ‘মেয়েদের বিরুদ্ধে যারা অপরাধ করে, তারা যেন ভয় পায় এই ভেবে যে কয়েক জন পুলিশ অফিসার তাদের মেরে দেবে। হাতে হাতে বিচার!’ ভাইরাল হয়েছে তেলঙ্গানার মন্ত্রী কেটি রাম রাওকে করা একটি টুইট। এক ব্যক্তি সেখানে মন্ত্রীকে ‘এনকাউন্টারের’ পরামর্শই দিয়েছিলেন।
মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ মনে করছেন, এনকাউন্টার নিয়ে একাংশের ‘উল্লাস’, মনের গোপন প্রতিশোধস্পৃহারই প্রকাশ। তাঁর কথায়, “আমাদের পাঠ্যক্রমে প্রতিহিংসাপরায়ণ না-হওয়ার শিক্ষা পাইনি। তাই এমন প্রবণতা।” সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের মতে, “এনকাউন্টারের মতো ঘটনা যদি সমর্থন পায়, তা হলে তার অপব্যবহারের আশঙ্কাও বেড়ে যায়।”
সমাজে পরিচিত ব্যক্তিত্বও যখন এই প্রবণতাকে সমর্থন করেন, তখন তা আরও সমস্যার বলে জানাচ্ছেন মোহিত। তিনি বলছেন, “সামাজিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার আগে আইকনদের সমাজতত্ত্বের পাঠ নেওয়া উচিত। কারণ, তাঁদের মতামত অন্যদের প্রভাবিত করে।” মোহিতের কথায়, ‘‘কেন গণধর্ষণে অভিযুক্তেরা জামিন পেল, নির্যাতিতাকে নিরাপত্তা দিতে কেন ব্যর্থ প্রশাসন— সেই প্রশ্ন তোলা উচিত। আইন হাতে তুলে নেওয়া সমর্থন করা যায় না। তা হলে মধ্যযুগে ফিরে যেতে হয়।”
‘এনকাউন্টার’ ঘিরে এ দিন সমাজমাধ্যমে রাজনৈতিক তির্যক মন্তব্যও দেখা গিয়েছে। এক জন লিখেছেন, ‘৬ ডিসেম্বরের ভোরে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক! একজন কামদার বলছেন, বলেছিলাম না, উন্নাও গণধর্ষণ নিয়ে আর কেউ কথা বলবে না।’