Kavach System

বন্দে ভারতে বিপুল অর্থ, টাকা নেই কবচ ব্যবস্থায়

গত বছর ঘটা করে অটোম্যাটিক ট্রেন প্রোটেকশন (এটিপি) সিস্টেম বা ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু করেছিল রেল মন্ত্রক। দুর্ঘটনা এড়াতে তা প্রায় ‘নিখুঁত’ বলে দাবিও করেছিল তারা।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩ ০৭:৫৩
Share:

গ্রাফিক: অমিতাভ চন্দ্র।

চমকের রাজনীতিকেই প্রাধান্য! তাই প্রতি সপ্তাহে দৌড় শুরুর জন্য প্রস্তুত হয় গড়ে দু’টি করে বন্দে ভারত ট্রেন। লোকসভা ভোটের বছরে অন্তত দু’শোটি শহরের মধ্যে বন্দে ভারত চালানোই লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদী সরকারের। তার জন্য ঢালাও অর্থের ব্যবস্থা। কিন্তু উপেক্ষিত হয় নিরাপত্তাজনিত বনিয়াদি পরিকাঠামোর সংস্কার। যাত্রী নিরাপত্তাকে শিকেয় তুলে বসানো হয় না ‘অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস’ (কবচ)। পাল্টায় না পুরনো সিগন্যালিং ব্যবস্থা, ভাঙাচোরা কামরা, সংস্কার না-হওয়া শতাব্দীপ্রাচীন রেলসেতু। ঘটে যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের মতো দুর্ঘটনা।

Advertisement

গত বছর ঘটা করে অটোম্যাটিক ট্রেন প্রোটেকশন (এটিপি) সিস্টেম বা ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালু করেছিল রেল মন্ত্রক। দুর্ঘটনা এড়াতে তা প্রায় ‘নিখুঁত’ বলে দাবিও করেছিল তারা। কিন্তু গত এক বছরে শুধু দক্ষিণ-মধ্য রেলের ১০৯৮ কিলোমিটার লাইন ও ৬৫টি ট্রেনকে কবচ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। গত কালের দুর্ঘটনার পরেই রেল মন্ত্রকের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা স্বীকার করে নিয়েছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনগুলিতে কিংবা সার্বিক ভাবে ওই রুটেই কবচ ব্যবস্থা চালু হয়নি। রেলকর্তাদের আক্ষেপ, হাওড়া-চেন্নাই রুটে কবচ ব্যবস্থা থাকলে ওই দুর্ঘটনা অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব হত। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বসানো হচ্ছে না কবচ?

যেখানে প্রতি সপ্তাহে এক-একটি ১১৫ কোটি টাকা মূল্যের দু’টি করে বন্দে ভারত ট্রেন ছোটার জন্য প্রস্তুত হতে পারে, সেখানে কেন ওই অর্থ যাত্রী নিরাপত্তায় খরচ করা হবে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। রেলের জবাব, কবচ ব্যবস্থা রূপায়িত করতে গেলে প্রতি কিলোমিটারে ৫০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। যার অর্থ, ৬৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে ওই ব্যবস্থা রূপায়িত করতে খরচ হওয়ার কথা ৩২ হাজার কোটি টাকা। তাদের হাতে ওই পরিমাণ অর্থ নেই।

Advertisement

আর এখানেই উঠেছে একাধিক প্রশ্ন। করোনা-কাল থেকে প্রবীণ যাত্রীদের টিকিটে ছাড় দেওয়া বন্ধ করে বিপুল আয় হয়েছে বলে স্বীকার করেছে রেলই। এ ছাড়া, গত কয়েক বছরে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম দ্বিগুণ করে, প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে ‘সুপারফাস্ট’ নাম দিয়ে এবং ডায়নামিক প্রাইসিং-এর নামে যাত্রীদের থেকে বেশি টাকা আদায় করা চলেছে। ব্যয়সঙ্কোচের সরকারি নীতি মানতে গিয়ে রেলে প্রায় দেড় লক্ষ পদ খালি, যার বড় অংশই নিরাপত্তা সংক্রান্ত। এই ‘লাভের কড়ি’ কোন কাজে লাগছে?

গ্রাফিক: অমিতাভ চন্দ্র।

তৃণমূলের রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক সুখেন্দুশেখর রায়ের কথায়, ‘‘বন্দে ভারতের ছবি দেখিয়ে ভোট চাওয়া যায়। কবচ ব্যবস্থা রূপায়িত হলে তা যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বটে, কিন্তু তা দেখিয়ে ভোট চাওয়া যায় না।’’ মাঝরাস্তায় বিকল হওয়া, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, সময়ে না-চলা, যাত্রাপথে মাঝেমধ্যেই গবাদি পশুর ধাক্কায় দাঁড়িয়ে পড়া বন্দে ভারত এখন ‘মন্দে ভারত’ হয়েছে বলে কটাক্ষ সুখেন্দুশেখরের। তাঁর দাবি, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উদাহরণ মেনে বর্তমান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবেরও ইস্তফা দেওয়া উচিত। যদিও সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন বৈষ্ণব।

বিরোধীদের বক্তব্য, বন্দে ভারত দিয়ে মোদী চমকের রাজনীতি করতেই পারেন। কিন্তু সেই বন্দে ভারত ট্রেন তো ছুটবে ‘কবচবিহীন’ পুরনো পথে! যেখানে ‘কবচ’ অনুপস্থিত, সেখানে দ্রুতগামী ওই ট্রেন কতটা সুরক্ষিত, সে প্রশ্ন তাই উঠছে। বিরোধী নেতাদের মতে, বন্দে ভারত উৎপাদনে জোর না দিয়ে সরকারের উচিত দেশ জুড়ে কবচ ব্যবস্থার প্রয়োগে টাকা খরচ করা। আধুনিক পরিষেবার চেয়েও বেশি জরুরি যাত্রীদের নিরাপত্তা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেলমন্ত্রিত্বের সময়ে হওয়া একের পর এক রেল দুর্ঘটনার পরেই অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়। রেলের দাবি, সে সময়ে ওই যন্ত্র তৈরি হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাতে বেশ কিছু ত্রুটি দেখা দেয়। তার পরে প্রায় দশ বছর ধরে ওই ব্যবস্থার উপরে কাজ করে গত বছর দক্ষিণ-মধ্য রেলে অবশেষে সফল প্রয়োগ হয়। রেলের দাবি, যাত্রী-সংখ্যার কথা মাথায় রেখে ৩০ হাজার কিলোমিটার রেললাইনে কবচ চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাওড়া-দিল্লি ও দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো লাইনকে আগামী বছরে কবচের আওতায় আনা হবে বলে দাবি রেলের।

দু’টি ট্রেন এক লাইনে চলে এলে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করে সংঘর্ষের অনেক আগেই ট্রেনদু’টিকে দাঁড় করিয়ে দেয় উভয় ট্রেনে থাকা কবচ ব্যবস্থা। চালক সিগন্যাল উপেক্ষা করে এগোনোর চেষ্টা করলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে গাড়ি থামিয়ে দেবে কবচ। লাইনে কোনও বাধা (পাথর বা দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের কামরা) এসে পড়লেও দূর থেকেই সেটিকে চিহ্নিত করে ট্রেন থামিয়ে দেবে কবচ। মন্ত্রকের দাবি, কবচ এতটাই সুরক্ষিত যে, দশ হাজার বছরেও সামান্যতম ভুল হওয়া সম্ভব নয়। তবে রেলের যুক্তি, হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ধাপে ধাপে আগামী দশ বছরে ওই প্রকল্প রূপায়ণ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

তত দিন প্রাণ হাতে রেলযাত্রাই দেশবাসীর ভবিতব্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement