গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বড় ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। ৫৯টি চিনা অ্যাপকে ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সব অ্যাপ বা এই সংস্থাগুলোকে ভারতে আর ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু ভারত সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই কি অ্যাপগুলো অকেজো হয়ে গেল? শুধুমাত্র এই ঘোষণার জেরেই কি টিকটক, হেলো, শেয়ারইট, ইউসি ব্রাউজার-রা ভারতে কাজ করা বন্ধ করে দিল? না, তা তো নয়। ভারত সরকারের ঘোষণার পরেও তো এই অ্যাপগুলো ভারতে ক্রিয়াশীল। তা হলে এগুলো বন্ধ বা অকেজো কবে থেকে হবে? কী ভাবেই বা হবে? এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। জবাব হাতড়াচ্ছে গোটা দেশ। আর সেই জবাব দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হচ্ছে, অ্যাপগুলোকে অকেজো করে দেওয়ার প্রত্যক্ষ ক্ষমতা কিন্তু ভারত সরকারের হাতে নেই।
একটু ভেঙে বললে আরও স্পষ্ট হবে। ধরুন আপনি একটা অ্যাপ তৈরি করলেন। সেই অ্যাপটাকে কী ভাবে পৌঁছে দেবেন উপভোক্তাদের কাছে? পৌঁছে দিতে হবে গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোরের মাধ্যমে। অর্থাৎ অ্যাপটাকে বাজারে ছাড়তে হলে গুগল প্লে স্টোর এবং অ্যাপল স্টোরে সেটার রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। কোন কোন দেশে অ্যাপটা ক্রিয়াশীল থাকবে, তা কিন্তু অ্যাপ নির্মাতা সংস্থা নিজেই স্থির করতে পারে ওই রেজিস্ট্রেশনের পরে। একটি তালিকা অ্যাপ নির্মাতার সামনে খুলে দেয় প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোর। অ্যাপ নির্মাতা সেই তালিকায় যতগুলি দেশকে সিলেক্ট করেন, ততগুলি দেশেই অ্যাপটি ক্রিয়াশীল হয়। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনও দেশের সরকারের কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। তাই কোনও বিদেশি অ্যাপকে বন্ধ করে দেওয়ার প্রত্যক্ষ ক্ষমতাও সরকারের হাতে নেই।
তা হলে কী ভাবে ভারতে বন্ধ হবে ৫৯টি চিনা অ্যাপ? যে নিষেধাজ্ঞা ২৯ জুন ঘোষণা করল ভারত সরকার, তা কার্যকর করা হবে কী ভাবে? তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। দেখে নেওয়া যাক সেগুলো কী কী।
আরও পড়ুন: চিনকে কোনও তথ্য পাচার করেনি তারা, দাবি টিকটকের
প্রথমত, যে ৫৯টি অ্যাপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, সেই সংস্থাগুলোকেই ভারত সরকার সরাসরি নির্দেশ দিতে পারে ভারত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। যে সংস্থা নির্দেশ মেনে নেবে, তারা গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোরের চেক লিস্টে ভারতের নামের পাশে থাকা চেকবক্সকে আনসিলেক্ট করে দেবে। এইটা করলেই ভারতে আর ওই অ্যাপ পাওয়া যাবে না।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারত সরকার নির্দেশ দিলেই কি চিনা অ্যাপ সংস্থা ভারত থেকে চুপচাপ ব্যবসা গুটিয়ে বেরিয়ে যাবে? না-ও যেতে পারে। যদিও ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৭৯ ধারা অনুযায়ী এই ধরনের নির্দেশ দেওয়ার অধিকার ভারত সরকারের রয়েছে। এবং ভারতে ব্যবসা করছে যে সব সংস্থা, তারা এই আইন মানতে বাধ্য। কিন্তু চিনা সংস্থা যদি এখন সেই আইন না মানে, তা হলে কী হবে?
আরও পড়ুন: ‘গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন’, অ্যাপ নিষিদ্ধ করা নিয়ে প্রতিক্রিয়া চিনের
না মানলে রয়েছে দ্বিতীয় পন্থা। গুগল এবং অ্যাপলের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ভারত। আমার দেশে আমি যে অ্যাপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি, সেই অ্যাপ অবৈধ ভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে— এই অভিযোগ জানানো হবে। গুগল বা অ্যাপলের দফতরে যদি কোনও অ্যাপের বিরুদ্ধে এই অবৈধ কার্যকলাপের অভিযোগ জমা পড়ে, তা হলে তার তাৎপর্য কিন্তু অনেক বড়। শুধু অবৈধ কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলে কোনও অ্যাপ কিন্তু শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই সমস্যার মুখে পড়তে পারে।
তবে প্রশ্ন এখানেও থাকছে। তা হল, গুগল বা অ্যাপল কি ভারত সরকারের কথা মানবে? আমার মনে হয়, পরিস্থিতি এখন যে রকম, তাতে ভারত সরকারের কথা গুগল বা অ্যাপল এখন মেনে নেবে। চিন এমনিতেই নানা কারণে আন্তর্জাতিক শিবিরে কোণঠাসা। গুগল বা অ্যাপলের সদর দফতরও চিনে নয়, আমেরিকায়। ওই দুই সংস্থার সঙ্গে বা আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যে রকম, তাতে ওদের মাধ্যমে ৫৯টি চিনা অ্যাপকে ভারতে অকেজো করে দেওয়া ভারত সরকারের পক্ষে খুব একটা কঠিন হবে না।
একটা তৃতীয় পন্থাও রয়েছে। ভারত সরকার নিজের দেশের নাগরিকদের নির্দেশ দিতে পারে ওই ৫৯টি অ্যাপ আনইনস্টল করার। সরকারের এই নির্দেশ কিন্তু নাগরিকরা মানতে বাধ্য। এই নির্দেশ কেউ না মানলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তাঁর কারাদণ্ডের সংস্থানও কিন্তু রয়েছে। কিছু চিনা মোবাইল থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট অ্যাপ আনইনস্টল করার অপশন নেই, সে কথা ঠিক। কিন্তু সবার মোবাইল চিনা নয়। এবং চিনা মোবাইল হলেও এই ৫৯টির মধ্যে অধিকাংশ অ্যাপকেই আনইনস্টল করা যায়।
সরকারি নির্দেশ মেনে যদি নাগরিকরা গণহারে আনইনস্টল করতে থাকেন নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া চিনা অ্যাপগুলি, তা হলে কিন্তু ওই সব সংস্থা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে। অ্যাপ চালু রাখার জন্য খরচও তো রয়েছে। যদি ব্যবসা পুরোপুরি গুটিয়ে যায় অর্থাৎ যদি ভারতীয়রা ওই সব অ্যাপকে পুরোপুরি বর্জন করে দেন, তা হলে এ দেশে ওই সব অ্যাপের ব্যবসা বলতে আর কিছু থাকবে না। খরচটুকুও উঠবে না। ফলে ব্যবসা গুটিয়ে যাবেই।