গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০২০ সালের দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন, উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে হিংসার আগের কথা। বিজেপি, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির আইটি সেল থেকে ফেসবুকে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে অপপ্রচার, জনমত তৈরি বন্ধ করতে, ভুয়ো অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা চলছিল। কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বার হওয়ায় পিছিয়ে যান ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। দেখা যায়, বিজেপির এক প্রভাবশালী লোকসভা সাংসদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এই রকম কিছু ভুয়ো অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।ফেসবুকের প্রাক্তন ডেটা সায়েন্টিস্ট সোফি ঝ্যাং সে সময় এই সব ভুয়ো (ফেক) অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করার কাজ করছিলেন। সোফির দাবি, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির সঙ্গে যুক্ত ভুয়ো অ্যাকাউন্টের খোঁজ পাওয়ার পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিজেপির এক সাংসদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ভুয়ো অ্যাকাউন্টের চক্রের যোগ মিললেও, ফেসবুক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বিজেপির এই নেতা হলেন দিল্লি লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের কৌশাম্বীর সাংসদ বিনোদ সোনকার।সোনকার বিজেপির অন্যতম রাষ্ট্রীয় সম্পাদক। সংগঠনে ত্রিপুরার দায়িত্বে। সংসদীয় এথিকস কমিটির চেয়ারম্যান। ২০১৯-এর আগে যে পদে ছিলেন বিজেপির ‘মার্গদর্শক’ লালকৃষ্ণ আডবাণী।আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ দেশের প্রথম সারির ২২টি সংবাদমাধ্যমকে খতিয়ে দেখার জন্য সোফি এই সংক্রান্ত ফেসবুকের গোপন, অভ্যন্তরীণ নথি তুলে ধরেছেন। আমেরিকার এই ডেটা সায়েন্টিস্ট ২০১৮ থেকে ২০২০-র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দু’বছর ফেসবুকে কাজ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সোফির অভিযোগ, প্রায় সব দেশেই ফেসবুক শাসক দলকে একই ভাবে সুবিধা পাইয়ে দেয়। ভারতও ব্যতিক্রম নয়। তারই প্রমাণ, বিজেপি সাংসদের সঙ্গে যুক্ত ভুয়ো অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করা। সোনকার অবশ্য জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। ফেসবুকের অভিভাবক সংস্থা মেটা-ও বিজেপির প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ফেসবুক ছাড়ার পরেই সোফি মুখ খুলেছিলেন। গত অক্টোবরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাংসদদের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার পর এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সামনেও সোফি সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন। কমিটিতে ‘সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার’ নিয়ে আলোচনা চলছিল। সাংসদদের খতিয়ে দেখার জন্য যাবতীয় নথিও পাঠিয়েছিলেন। গত নভেম্বরে কমিটির চেয়ারম্যান শশী তারুর জানান, সোফির সাক্ষ্য নেওয়া হবে। সূত্রের খবর, এর জন্য কমিটির সচিবালয় থেকে স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি লিখে অনুমতি চাওয়া হয়। কারণ, সংসদীয় কমিটির সামনে বিদেশি নাগরিকের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য স্পিকারের ছাড়পত্র প্রয়োজন। ছয় মাস কেটে গেলেও স্পিকারের দফতর থেকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনও জবাবই আসেনি। অথচ কমিটির সব সাংসদই সোফির কথা শোনা উচিত বলে একমত ছিলেন। ইতিমধ্যে কমিটিতে ‘সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার’ সম্পর্কে সকলের সাক্ষ্য নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সংসদীয় কমিটিকে তাঁর বক্তব্য জানানোর সুযোগ আর মিলবে না বুঝে সোফি এ বার সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।ঠিক কী অভিযোগ করছেন সোফি? ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ গোপন নথিতেই বা কী রয়েছে?সোফির দাবি, ২০১৯-এর শেষ থেকে ২০২০-র গোড়ার মধ্যে তিনি মোট পাঁচটি ভুয়ো অ্যাকাউন্টের চক্রের সন্ধান পান। এর মধ্যে দু’টি কংগ্রেসের, একটি আম আদমি পার্টি ও দু’টি বিজেপির হয়ে কাজ করছিল। প্রথমে পাঁচটি চক্রই বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বিজেপির একটি চক্রের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসে। এই চক্রটিতে সোনকারের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে প্রায় ৫০টি ভুয়ো অ্যাকাউন্ট যুক্ত ছিল। এই ভুয়ো অ্যাকাউন্টগুলো থেকে সোনকারের ফেসবুক পোস্ট ‘লাইক’ বা ‘শেয়ার’ করা হত। যাতে তা আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। বিজেপি সাংসদ নিজে বা তাঁর ফেসবুক চালান এমন কোনও সহকারী এই ভুয়ো অ্যাকাউন্টগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের কাজ করছিলেন। সোফির নথি অনুযায়ী, এই সব অ্যাকাউন্টকে ফেসবুকের নিজস্ব ব্যবস্থায় ‘গভর্নমেন্ট পার্টনার’ বা ‘হাই প্রায়োরিটি ইন্ডিয়ান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যাতে ভাল ভাবে খতিয়ে দেখে তবেই কোনও পদক্ষেপ করা হয়। সোফি সোনকারের অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়ার পরে ফেসবুকের অন্দরে প্রশ্ন ওঠে, এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে তাঁরা স্বচ্ছন্দ তো? শেষে কোনও পদক্ষেপই হয়নি।বিনোদ সোনকার অবশ্য বলছেন, তিনি এ সব বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাঁর বক্তব্য, “আমি তথ্যপ্রযুক্তিতে এত স্বচ্ছন্দ নই। আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। নিজস্ব আইডি থেকেই তা চলে। সত্যতা যাচাই করা অ্যাকাউন্ট। তা ছাড়া, যদি ভুয়ো কোনও অ্যাকাউন্ট থাকে, তা বন্ধ করতে কে বারণ করেছে? ফেসবুক কেন সেগুলো ব্লক করেনি?” সোনকারের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত ভুয়ো অ্যাকাউন্টগুলি থেকে বিদ্বেষ ছড়ানো হত, এমন প্রমাণও নেই। সোফি যদিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দিল্লির ভোটের আগে ওই সময় নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছিল। রাজনৈতিক মহলের অবশ্য বক্তব্য, বিভিন্ন দলের আইটি সেলগুলি এ ভাবেই কাজ করে। এক জন নেতার অ্যাকাউন্টের সঙ্গে বিভিন্ন ভুয়ো অ্যাকাউন্ট জুড়ে দিয়ে প্রচার চালায়। গত কয়েক বছরে এ দেশেও কোনও নেতার বা রাজনৈতিক দলের ফেসবুক-টুইটারে ‘ফলোয়ার’-দের ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করে, তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া, তাঁর জনপ্রিয়তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর অভিযোগ বার বার উঠছে।সোফির মতে, এ হল মেকি পদ্ধতিতে গণতন্ত্রকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। রাহুল গান্ধী সম্প্রতি দাবি করেছেন, বিজেপি এ ব্যাপারে অনেক এগিয়ে। রাজনীতিকদের মধ্যে টুইটারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ফলোয়ার সবথেকে বেশি। চার বছর আগে টুইটারের তদন্তে জানা গিয়েছিল, মোদীর ৬০ শতাংশ ‘ফলোয়ার’-ই ভুয়ো। সোফির বক্তব্য, “ভুয়ো অ্যাকাউন্ট কাজে লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের কথা ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। একই লোক কয়েকশো ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের হয়ে কথা বললে, কারও সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ালে, আমজনতার মনে হবে, সেটা অনেকের মত। ভোটেও তা প্রভাব ফেলবে।”সম্পূর্ণ একমত তৃণমূল সাংসদ, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটির সদস্য মহুয়া মৈত্র। তাঁর বক্তব্য, “এই কারণেই আমরা সংসদীয় কমিটিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ, এভাবে জনমত তৈরির চেষ্টা নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নির্বাচনে প্রচারপদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে।” তাঁর মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো অ্যাকাউন্টের চক্র তৈরি করে জনমত তৈরি বা সামাজিক বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা হলে, ফেসবুকের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা সে যাঁরাই এ কাজ করুক।নেটদুনিয়ার অপব্যবহার রুখতে সক্রিয় অসরকারি সংগঠন ‘ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন’-এর তরফে সংসদীয় কমিটিকে চিঠি লিখে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার আর্জি জানানো হয়েছিল। ফাউন্ডেশনের বক্তব্য, একই ব্যক্তি একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে, সেইসব নকল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। বাস্তবে কত জন ফেসবুক ব্যবহার করছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে তার ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। ফলে নকল অ্যাকাউন্টের হিসেব মেলেনি। এই সব অ্যাকাউন্ট থেকে রাজনৈতিক স্পর্শকাতর তথ্য ছড়ানো হয়। ফাঁস হওয়া নথি দেখে বলা যায়, ফেসবুক মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানো সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু রাজনৈতিক হিসেব কষে কোনও পদক্ষেপ করেনি। সোফির আগে ফেসবুকের আর এক প্রাক্তন কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেনও অভিযোগ তুলেছিলেন, ২০২০-তে দিল্লির হিংসার আগে ফেসবুকে মুসলিম বিরোধী প্রচার, ভুয়ো তথ্য ছড়ানো হলেও ফেসবুক নড়ে বসেনি। ওই বছরই ফেসবুক ইন্ডিয়া-র পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর আঁখি দাসের বিরুদ্ধে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। আঁখি পদত্যাগ করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন শিবনাথ ঠুকরাল।সোফির দাবি, তিনি পঞ্জাবের কংগ্রেসের তিন বিধায়কদের তৈরি আইটি সেল থেকে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করার আট ঘণ্টার মধ্যে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দিল্লির ভোটের আগে আম আদমি পার্টির আইটি সেলের তৈরি ভুয়ো অ্যাকাউন্টেরও খোঁজ মেলে। এই অ্যাকাউন্টগুলির মালিকরা নিজেদের বিজেপি সমর্থক বলে দাবি করে দিল্লির ভোটে অরবিন্দ কেজরীবালকে ভোট দেওয়া উচিত বলে প্রচার করছিল। যাতে বিজেপি সমর্থকদের আপ-এর পক্ষে টেনে আনা যায়। ফেসবুক এ ক্ষেত্রে প্রথমে গড়িমসি করলেও পরে সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। গোপন নথি তুলে ধরে সোফির দাবি, সে সময় ফেসবুক ইন্ডিয়া-র এক কর্মী তাঁকে জানান, ‘আম আদমি পার্টি বিজেপির নকল করে বিজেপির অনলাইন খেলাতেই তাদের হারাতে চাইছে’। তবে ‘বিজেপির অনলাইন সেনা’-র সংখ্যা অনেক বেশি। সোফির বক্তব্য, “এ থেকে স্পষ্ট, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানে যে ফেসবুকে বিজেপির আইটি সেল রয়েছে। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ করতে চায় না।”কী বলছেন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ?ফেসবুকের মালিক সংস্থা মেটা-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মেটা-র এক মুখপাত্র আনন্দবাজারকে বলেন, “আমরা আগেই বলেছি, সোফির বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত নই। বিশ্ব জুড়েই ফেসবুকের অপব্যবহার রুখতে আগ্রাসী পদক্ষেপ করা হচ্ছে। বিশেষ টিম কাজ করছে। দেড়শোর বেশি ভুয়ো অ্যাকাউন্টের চক্র বন্ধ করা হয়েছে। ভারতের চক্রও রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে তদন্ত করে পদক্ষেপ করা হয়।”ফেসবুক বিজেপিকে ছাড় দিয়ে থাকে বা বিজেপির আইটি সেল সম্পর্কে নরম মনোভাবের অভিযোগের জবাবে মেটা-র মুখপাত্র বলেন, “এটা পুরোপুরি মিথ্যে ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ। আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে সীমিত বোধের প্রতিফলন। ভুয়ো অ্যাকাউন্ট বা বিদ্বেষমূলক পোস্ট সম্পর্কে কেউই একা সিদ্ধান্ত নেন না। সংস্থার বিভিন্ন বিভাগের মত নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ভারতের পাবলিক পলিসি টিমেও কেউ একজন সিদ্ধান্ত নেয় না। স্থানীয় আইন মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা-ও দেখা হয়। কোনও রাজনৈতিক দল বা অবস্থানের সঙ্গে পক্ষপাত না করে আমাদের নীতি মেনে কাজ হয়।”
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।