চলছে ভোট। সুরেন্দ্রনগরের লিমডিতে। ছবি: পিটিআই।
দৃশ্য ১: একটাও ফেস্টুন নেই, ব্যানার নেই, রাস্তার এ পার থেকে ও পার পর্যন্ত দড়ি বেঁধে সার সার পতাকাও ঝোলানো নেই। কোনও কোনও এলাকায় ভোটের বুথে পৌঁছনোর পথে চেয়ার-টেবিল পেতে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা বসে রয়েছেন বটে। তবে ঝান্ডা তো দূরের কথা, বুকে রাজনৈতিক দলের ব্যাজটাও নেই। কোনটা কোন দলের ক্যাম্প, বোঝাই যায় না। কোনও কোনও এলাকায় আবার এই চেয়ার-টেবিল পাতার প্রয়োজনও বোধ করেননি স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা।
দৃশ্য ২: সুরেন্দ্রনগর জেলায় হাইওয়ের ধারেই কংগ্রেসের নির্বাচনী কার্যালয়। আশেপাশে কোনও ভোটের বুথ নেই। তবু বেশ কিছু কর্মী সকাল থেকে ওই কার্যালয়েই বসে রয়েছেন। হাল্কা মেজাজে গল্পগুজব, মাঝে-মধ্যে মশলা চায়ের কাপে চুমুক বা গাঠিয়ার প্যাকেট খুলে ভাগাভাগি করে নেওয়া— এই চলছে। কে জিতবে? ভরপুর প্রত্যয় নিয়ে জবাব এল, কংগ্রেস জিতবে।
কেন জিতবে কংগ্রেস? ব্যাখ্যা করতে এগিয়ে এলেন সন্দীপভাই মের। বাকিরা হিন্দিতে খুব সড়গড় নন। তাই সন্দীপই ভরসা। বললেন, ‘‘এই এলাকায় কাপাসের (তুলো) চাষই হল মানুষের আয়ের মূল উৎস। কিন্তু কাপাসের দাম সাংঘাতিক পড়ে গিয়েছে। কৃষকরা চাষের খরচও তুলতে পারেননি। পাতিদাররাও এ বার বিজেপির উপর সন্তুষ্ট নন। তাঁরাও কংগ্রেসকে ভোট দেবেন।’’ যেখানে এই কথোপকথন চলছে, তার পাশেই নাস্তা-পানির দোকানে বসে প্রাতঃরাশ সারছেন কয়েক জন বিজেপি কর্মী। আলাপচারিতা তাঁদের কানেও পৌঁছচ্ছে। কিন্তু কেউ সামান্যতম উত্তেজনাও দেখাচ্ছেন না। প্রতিবাদ করার কোনও চেষ্টাই করছেন না।
দৃশ্য ৩: লিমডির ভিতরে এক বুথের সামনে ইতিউতি ছড়িয়ে বিজেপি কর্মীরা। ভোট কেমন চলছে? —‘‘খুব ভাল। রেকর্ড ভোট পড়বে এ বার।’’ ফলাফল কী হবে? এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন তরুণী বিজেপি কর্মী। স্থানীয় নেতা বারণ করে দিলেন। বললেন, ‘‘এ সব প্রশ্ন করবেন না। বুথের সামনে এ ভাবে মতামত দেওয়া যায় না।’’
দৃশ্য ৪: ছুটির মেজাজ, আনন্দ করেই ভোট দিতে যাচ্ছেন লোকজন, দোকান-বাজার বেশির ভাগই বন্ধ। আর বন্ধ দোকানপাটের সিঁড়িতে বসে ইতিউতি আড্ডা তরুণদের। থমথমে হাবভাব নয়, হাসিঠাট্টার মেজাজেই সকলে। ভোটের হালচাল নিয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি আছেন? ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই’, ঝটিতি জবাব। এক জন আবার আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘‘আমরা সবাই এক কথাই বলব, আলাদা কিছু বলার নেই, বিজেপি-ই জিতবে।’’ বাকিরাও সেই সুরেই সুর মেলালেন। এক জন উঠে পড়লেন সিঁড়ি থেকে, হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘না, না, আমি কংগ্রেস।’’ বাকিরাও হেসে উঠলেন, ‘‘হ্যাঁ, ও-ই একমাত্র কংগ্রেস আমাদের মধ্যে।’’
আরও পড়ুন: ইভিএম অভিযোগ নিয়েই মিটল গুজরাতের প্রথম দফার ভোট
চমকে না গিয়ে উপায় কী! ভোটের ছ’মাস আগে থেকে শোনা যাচ্ছে, জবরদস্ত লড়াই গুজরাতে। বিজেপি-কংগ্রেস সেয়ানে সেয়ানে। প্রবল উত্তেজনাই প্রত্যাশিত। এই নাকি সেই ‘উত্তেজনা’র নমুনা! বেশ কিছু বুথে ইভিএম কারচুপির অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও জানিয়েছে। কমিশন পদক্ষেপও করেছে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে। কিন্তু ভোট ঘিরে অনিয়মের অভিযোগ সেটুকুতেই শেষ।
রাজকোটের লিমডির এক বুথে...ছবি: রয়টার্স।
কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নির্বাচন দেখতে অভ্যস্ত যে চোখ, সে চোখে এর চেয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট আর কী হতে পারে? সারা বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও পরস্পরের থেকে দূরে সরে যান ভোট মরসুমের বাংলায়। দল আলাদা হলে বাপ-ছেলের হাঁড়ি আলাদা হওয়ার উপক্রম হয় পশ্চিমবঙ্গে। ভোটকেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও চাটাই পাতা যাবে না বলে কমিশন বার বার জানায়, পতাকা-ফেস্টুন-ব্যানার ঝোলাতে বারণ করা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বাংলার ভোট নিজের গতিতেই চলে।
গুজরাতের ভোটও কিন্তু নিজের গতিতেই। কাকে ভোট দিচ্ছেন, সে কথা প্রকাশ্যে বলতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু ভোটের দিন কী করা উচিত আর কী উচিত নয়, তা মাথায় রাখতেও কারও সমস্যা নেই।
আরও পড়ুন: ১০৬ বছর বয়সে ভোট দিলেন ডাণ্ডি অভিযানে অংশ নেওয়া মোতলি বা
জ্বলন্ত সমস্যা নিয়েই কিন্তু এ বার ভোটে গিয়েছে গুজরাত। সংরক্ষণের দাবিতে পাতিদার বিক্ষোভ, কাপাস এবং বাদামের দাম পড়ে যাওয়া, জিএসটি এবং নোটবন্দির জেরে দক্ষিণ গুজরাতের রমরমা বণিক মহল্লায় জোর ধাক্কা লাগা, ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটা দলের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ— এতগুলি বিষয় কিন্তু বিজেপি-র বিরুদ্ধে যাচ্ছে এ বারের ভোটে।
ভোট দিয়ে বের হলেন ক্রিকেটার চেতেশ্বর পূজারা। শনিবার রাজকোটে তোলা পিটিআইয়ের ছবি।
সে সবের মোকাবিলা বিজেপি করছে কীসের ভিত্তিতে? প্রথমত, উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। নর্মদার জল রাজ্যের কোনায় কোনায় পৌঁছে দিয়ে কী ভাবে জলকষ্ট লাঘব করা হয়েছে, তার খতিয়ান তুলে ধরা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রধানমন্ত্রী গুজরাতি হলে গুজরাতের কতটা লাভ, সে কথা বোঝানোর চেষ্টা চলছে। গুজরাতি প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্ত করার জন্য গুজরাতে বিজেপিকে জেতানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, গুজরাতি অস্মিতার প্রশ্নে আচমকাই বিজেপি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। মণিশঙ্কর আইয়ারের মন্তব্যকে হাতিয়ার করে নিজেদের পালে জোরদার হাওয়া টানার চেষ্টা করছেন মোদী। অন্য সব ইস্যু ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। চতুর্থত, পাতিদারদের সমর্থন ধরে রাখতে হার্দিকের পাল্টা ব্যক্তিত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদী নিজে। সম্প্রদায়ের গুরুদেবের আশীর্বাদ নিয়েছেন তিনি, সমর্থন চেয়েছেন। ইতিবাচক আশ্বাসও পেয়েছেন।
সব অর্থেই গুজরাতের নির্বাচন রঙিন এ বার, লড়াইও টানটান। কিন্তু প্রথম দফার ভোটগ্রহণ দেখিয়ে দিল, নির্বাচনী উত্তেজনার সীমাটাও জানা রয়েছে গুজরাতের।