জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী
পুরনো একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি সেনাপ্রধান। খবর এল, গোর্খা ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন-কে পাঠানো হচ্ছে কাশ্মীরে। এমন একটা জায়গায় যেখানে প্রতিনিয়ত গুলি-গোলা চলছে।
ওই ব্যাটেলিয়নের চিফ মেডিক্যাল অফিসার এক মহিলা। নামটা যতদূর মনে পড়ছে ডক্টর লক্ষ্মী। আমার কাছে খবর আসায় আমি বারণ করে দিয়েছিলাম, ব্যাটেলিয়ন গেলেও ওই মহিলাকে এমন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো যাবে না। আমি সেনাপ্রধান, আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কেউ তার উপরে কথা বলতে পারবে না।
দিন কয়েকের মধ্যে আলাদা করে সাক্ষাৎ চেয়ে সটান আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ডক্টর লক্ষ্মী। তাঁর দাবি, তাঁকে যেতে দিতে হবে। মনে আছে, বলেছিলেন, ‘আমার ব্যাটেলিয়ন যাবে অথচ আমি যাব না, এটা আপনি ভাবলেন কী করে!’ মহিলার সাহস দেখে ভাল লেগেছিল। আমি আমার আগের নির্দেশ ফিরিয়ে নিয়ে লক্ষ্মীকে সেখানে পাঠানোর কথা বলি।
এর কয়েক দিন পরে খবর পাই, প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে এক গোর্খা জওয়ানের শরীরে গুলি লাগে এবং তিনি আহত অবস্থায় সেখানেই পড়েছিলেন। তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। অথচ অবিলম্বে তাঁর রক্তের প্রয়োজন ছিল। ডক্টর লক্ষ্মী খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান এবং ওখানে বসেই গোলাগুলির মধ্যে হাতে বোতল ধরে ওই জওয়ানকে রক্ত দেন। পরে লক্ষ্মীকে তাঁর এই অকুতোভয় মানসিকতার জন্য বীরত্বের পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
এই গল্পটা বলার কারণ, আমি বার বার দেখেছি, মহিলারা কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। সেনাবাহিনীতে মহিলাদের এই স্থায়ী কমিশনড পদে নিয়োগ যথাযথ বলে মনে হয়। তবে একটি বিষয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। যেখানে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে যুদ্ধ করতে হবে, সে ক্ষেত্রেও কি একই নিয়ম বলবৎ হবে? সুপ্রিম কোর্টের রায় যত টুকু দেখলাম, তাতে এই বিষয়ে কী বলা হয়েছে, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে, আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি চাই না, মহিলাদের সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হোক। মনে হতে পারে আমি বৈষম্যের কথা বলছি। তা নয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদতে এখন লস্কর, জইশের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আমাদের ছায়াযুদ্ধ চলছে। তারা কেউ জেনিভা কনভেনশনের পরোয়া করছে না। যুদ্ধ-বন্দিদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তা এই কনভেনশনে বলা আছে। কিন্তু, তা না মেনে অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে বন্দি জওয়ানদের উপরে।
এই অত্যাচার আমাদের দেশের মা-বোনদের উপরে হোক — আমি চাই না।
লেখক: প্রাক্তন সেনাপ্রধান