মাটির গভীরে নেমে যাচ্ছে কফিন। স্লোগান উঠছে, ‘গৌরী লঙ্কেশ অমর রহে...।’ কান্নাভেজা একটা সুর ভেসে বেড়াচ্ছে বেঙ্গালুরুর টি আর মিল গ্রাউন্ডের সমাধিক্ষেত্রে।
গত রাতে বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়ির সামনে খুন হওয়া সাংবাদিক গৌরীর আত্মীয়-বন্ধুরাই গাইছেন সেই গান। তাঁরা বলে দিয়েছিলেন, শেষকৃত্যে কোনও ধর্মীয় আচার পালন হবে না। অন্তিম মুহূর্তে রইল তাই শুধু পুলিশের গান স্যালুট। আর দেশজোড়া ক্ষোভ। সাংবাদিকদের, লেখকদের, ছাত্রছাত্রীদের— ছাপোষা নাগরিকদের। যাঁরা নতুন করে আওয়াজ তুলেছেন—‘ভিন্নমত প্রকাশ করলেই খতম করার এই রেওয়াজ শেষ হোক।’ নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাসও বলেছে, ‘‘ভারত ও সারা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই।’’
ভিড়ে ঠাসা সমাধিক্ষেত্রে হাজির মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। কফিনে ফুল দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘গৌরীর পরিবার যদি বিশেষ ভাবে চায়, সিবিআই তদন্তের ব্যাপারেও আমি খোলা মন নিয়ে চলছি।’’ ঘটনার রিপোর্ট চেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
আরও পড়ুন: চুপ করে থাকবো না, সরব গোটা দেশ
সাতটা গুলি করেছিল খুনি। চারটে লাগে দেওয়ালে। বাকি তিনটে গৌরীর বুক আর তলপেট ফুঁড়ে দেয়। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, একটা মোটরবাইকের আওয়াজও পাওয়া গিয়েছিল। গৌরীর ভাই ইন্দ্রজিৎ লঙ্কেশ বলছিলেন, ‘‘(গৌরীর) বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোয় সবটাই উঠেছে। আমি নিশ্চিত, জলদি ধরা পড়বে আততায়ী।’’ পাসওয়ার্ড-লক করা সিসিটিভি রেকর্ডার আপাতত পুলিশের জিম্মায়। সূত্র জানাচ্ছে, এক জন আততায়ী কালো পোশাক আর হেলমেট পরে এসেছিল বলে মনে করা হচ্ছে। যে রাস্তা দিয়ে গৌরী কাল বাড়ি ফিরেছিলেন, খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে সেই পথের সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজও।
শোকাহত: শেষ আদর দিদিকে। নিহত প্রবীণ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের কফিন আঁকড়ে কবিতা। বুধবার বেঙ্গালুরুতে।
কর্নাটকের আইনমন্ত্রী মেনেই নিয়েছেন, হিন্দুত্ব-বিরোধী ও বাম-মনস্ক গৌরীর খুনের সঙ্গে বছর দুয়েক আগে যুক্তিবাদী শিক্ষাবিদ এম এম কলবুর্গীর হত্যাকাণ্ডের যোগাযোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। গত রাত থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছিল আজ সারা দিনের প্রতিবাদ-কর্মসূচি। ছড়িয়ে পড়ছিল স্লোগান-হ্যাশট্যাগ— ‘আমি গৌরী, আমাদেরই নাম গৌরী’।
সরব গৌরীর শহর।
আজ তাঁর শেষযাত্রাতেও ঘুরেফিরে এসেছে ‘শহিদ’ শব্দটা। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, তিরুঅনন্তপুরম, কলকাতা— শহরে শহরে রাস্তায় নেমেছেন সাংবাদিকেরা। নিন্দায় ফেটে পড়েছে এডিটর্স গিল্ড থেকে ইন্ডিয়ান রাইটার্স ফোরাম। দিল্লির যন্তরমন্তর-সহ নানা জায়গা থেকে মিছিল এসে মিশেছে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ায়। সেই প্রতিবাদসভায় সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজা, কানহাইয়া কুমারের মতো বাম নেতারা ছাড়াও এসেছেন কংগ্রেস ও আপের প্রতিনিধিরা। কলকাতা প্রেস ক্লাবের মিছিলে হেঁটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মিছিল করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও। প্রতিবাদে সরব হয়েছে বলিউডও।
অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতিকেই দিনভর তীব্র ধিক্কার দিয়ে গিয়েছেন গৌরীর সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠরা। আর বলেছেন, জারি থাকবে তাঁর লড়াই। মৃত্যুর সাধ্য নেই তাতে দাঁড়ি টেনে দেওয়ার!
ছবি: পিটিআই