কয়লা-কাণ্ডে কাঠগড়ায়

প্রাক্তন কয়লাসচিব, বিড়লাকেও তলব

তাঁর পরিচয় আদ্যন্ত দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ হিসেবে। তিনি ভারতের আর্থিক সংস্কারের জনক। এবং জওহরলাল নেহরুর পরে একমাত্র তিনিই পরপর দু’বার বসেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে। সেই মনমোহন সিংহেরই এ বার আদালতে ডাক পড়ল দুর্নীতি-মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে। আজ কয়লা খনি বণ্টন দুর্নীতি মামলায় মনমোহন ছাড়াও ‘হিন্দালকো’ সংস্থার চেয়ারম্যান তথা শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লা, প্রাক্তন কয়লাসচিব পি সি পরাখ-সহ ছ’জনকে আগামী ৮ এপ্রিল আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিশেষ আদালতের বিচারক ভরত পরাশর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০৪:২৬
Share:

তাঁর পরিচয় আদ্যন্ত দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ হিসেবে। তিনি ভারতের আর্থিক সংস্কারের জনক। এবং জওহরলাল নেহরুর পরে একমাত্র তিনিই পরপর দু’বার বসেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে। সেই মনমোহন সিংহেরই এ বার আদালতে ডাক পড়ল দুর্নীতি-মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে।

Advertisement

আজ কয়লা খনি বণ্টন দুর্নীতি মামলায় মনমোহন ছাড়াও ‘হিন্দালকো’ সংস্থার চেয়ারম্যান তথা শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লা, প্রাক্তন কয়লাসচিব পি সি পরাখ-সহ ছ’জনকে আগামী ৮ এপ্রিল আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিশেষ আদালতের বিচারক ভরত পরাশর। ২০০৫ সালে কয়লা মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে হিন্দালকোকে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ওড়িশার একটি কয়লা খনি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মনমোহন বাড়তি সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। বিশ্বাসভঙ্গ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতি দমন আইনে মনমোহনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যার সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

নজিরবিহীন এই ঘটনায় আজ দেশের রাজনীতিতে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। তার প্রধান কারণ মনমোহনের ভাবমূর্তি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি সততা প্রমাণের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। তবে আদালতের সমনে যথেষ্টই ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। কংগ্রেসও অস্বস্তিতে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিজেপি যে উল্লসিত, তা-ও নয়। সরকারি ভাবে শাসক দল বলছে, ‘আইন আইনের পথে চলবে।’ কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতাদের আশঙ্কা, মনমোহন বিপদে পড়লে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধেই প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির অভিযোগ তুলবে বিরোধীরা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর তাই বলে দিয়েছেন, “এর মধ্যে কোনও প্রতিহিংসা নেই। কংগ্রেসের পাপের জন্য মনমোহনজিকে এ সবের মুখে পড়তে হচ্ছে।” তবে ব্যক্তিগত ভাবে আদালতের ‘অতিসক্রিয়তা’ নিয়ে বিজেপির একাধিক শীর্ষ আইনজীবী নেতা ক্ষুব্ধ। তাঁরা কেউ কেউ আজ এ ব্যাপারে মনমোহনের সঙ্গে কথাও বলেছেন।

Advertisement

আজ দুপুরে সংসদে সাংবাদিকদের সামনে মনমোহন নিজেও মেনে নিয়েছেন যে, আদালতের সমন আসায় তিনি যথেষ্ট ‘হতাশ’। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলেছেন, “এ সব জীবনের অঙ্গ।” তবে তিনি যে কোনও দুর্নীতিতে জড়িত নন, আজ ফের তা দাবি করেছেন মনমোহন। বলেছেন, “বিচার প্রক্রিয়াকে আমি সম্মান করি। আশা করি, যে কোনও নিরপেক্ষ বিচারে তথ্য-সহ বক্তব্য পেশের সুযোগ পেলে নিজের সততা প্রমাণ করতে পারব। যে কোনও আইনি পরীক্ষার জন্য আমি তৈরি।” এর আগে জানুয়ারি মাসে আদালতের নির্দেশে মনমোহনের বয়ান নথিভুক্ত করেছিল সিবিআই। তখনও মনমোহন জানান, তিনি কোনও রকম দুর্নীতিতে জড়িত নন। আজও সেই সুরে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি বিবৃতি দিয়ে ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি পেশ করেছিলাম।” মনমোহন জানান, তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবেন। সূত্রের খবর, সমনের উপর স্থগিতাদেশের আবেদন জানানো যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

কোনও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর অভিযুক্ত হিসেবে আদালতে ডাক পড়ার নজির এর আগে রয়েছে মাত্র এক বার। সাংসদ কেনাবেচার মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও। তিনটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ হয়। রাও অবশ্য সব ক’টিতেই ‘নির্দোষ’ আখ্যা পান। আদালতে ছাড় পেলেও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে বরাবরই ব্রাত্যজন হয়ে থেকে গিয়েছেন রাও। তবে কংগ্রেসের তরফে আজ সাংবাদিক বৈঠকে বলা হয়েছে, মনমোহন সম্পূর্ণ নির্দোষ। দল পুরোপুরি তাঁর পাশে রয়েছে। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালা বলেন, “মনমোহন সিংহর সততা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত।” এই সবই আসলে বিজেপির জমি বিল থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলে কংগ্রেসের অভিযোগ। মনমোহনেরমন্ত্রিসভার প্রাক্তন সতীর্থরাও তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন, শেষ পর্যন্ত কোনও অভিযোগই ধোপে টিকবে না। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা আইনজীবী কপিল সিব্বলের বক্তব্য, “মনমোহন সিংহ দুর্নীতিতে জড়িত বলে দেশের কেউ বিশ্বাস করে না। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে ওঁকে রক্ষা করব।” কিন্তু কংগ্রেসের একটা অংশ এখনও মনমোহনের পাশে কতখানি দাঁড়ানো উচিত, সে বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। ফলে মনমোহনের ভবিষ্যৎ আকাশে একটা আবছা প্রশ্নচিহ্ন দেখছেন কেউ কেউ।

কেন আদালতে অভিযুক্ত হিসেবে ডাক পড়ল মনমোহনের?

জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় এক দশক। ২০০৫। ওড়িশার তালাবিড়া-২ কয়লা খনিটি প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘মহানদী কোলফিল্ড’ ও ‘নেইভেলি লিগনাইট কর্পোরেশন’কে বরাদ্দ করেছিল সংশ্লিষ্ট স্ক্রিনিং কমিটি। সে সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের হাতেই ছিল মন্ত্রকের দায়িত্ব। তদন্তকারীদের বক্তব্য, কুমারমঙ্গলম বিড়লা মনমোহনকে চিঠি লিখে হিন্দালকোকে ওই খনি থেকে কয়লা দেওয়ার অনুরোধ করেন। কয়লা মন্ত্রকের যুক্তি ছিল, হিন্দালকো মহানদী কোলফিল্ডের থেকে কয়লা পেলেও তা কাজে লাগায়নি। বিড়লা তখন ফের চিঠি লিখে জানান, পরিকল্পনা মতো অ্যালুমিনিয়াম কারখানা তৈরি না হওয়ায় ওই কয়লা ব্যবহার হয়নি। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও তাঁকে সমর্থন করছেন বলে জানান বিড়লা। প্রধানমন্ত্রী বিড়লার অনুরোধ মেনে নেন। খনির ৭০% মহানদীকে, ১৫% নেইভেলিকে এবং বাকি ১৫% হিন্দালকোকে বরাদ্দ করা হয়। নবীন প্রকাশ্যে কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

২০১২। কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-র রিপোর্টে অভিযোগ ওঠে, নিলাম না করে খনি বণ্টনের জেরে কেন্দ্রের ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। শুরু হয় দেশ জুড়ে আলোড়ন। তদন্তে নামে সিবিআই। ২১৪টি কয়লাখনির বণ্টন বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ওড়িশার এই খনিটি বণ্টনের তদন্তে ২০১৩-র অক্টোবরে প্রাক্তন কয়লাসচিব পরাখ ও কুমারমঙ্গলম বিড়লার নামে এফআইআর করে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি। তাতে অবশ্য মনমোহনের নাম ছিল না। এর পরেই আদালতে তদন্ত বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে ‘ক্লোজার রিপোর্ট’ জমা দেয় সিবিআই। যুক্তি দেওয়া হয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। আদালত অবশ্য ‘ত্রুটিপূর্ণ’ রিপোর্টের জন্য সিবিআইকে ভর্ৎসনা করে তাদের তদন্ত চালিয়ে যেতে বলে। সেই সঙ্গে আদালত প্রশ্ন তোলে মনমোহনকে কেন জেরা করা হয়নি? আদালতের নির্দেশেই গত ২০ জানুয়ারি সিবিআই মনমোহনের বয়ান নেয়। সেই বয়ান আদালতে পেশ করা হয়। আজ সিবিআইয়ের তদন্ত বন্ধ করার আর্জি খারিজ করে দিয়ে বিশেষ আদালতের বিচারক নির্দেশ দেন, ছ’জন অভিযুক্তকেই আদালতে হাজির হতে হবে।

মনমোহনের পক্ষে অন্যতম প্রধান যুক্তি হল, কোনও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে একটি বিশেষ কয়লাখনি বণ্টনের খুঁটিনাটিতে নজরদারি করা সম্ভব নয়। মন্ত্রী ও আমলাদের উপরে ভরসা করে প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ফাইলেই সই করতে হয়। তাতে কোনও গণ্ডগোল থাকলেও তার জন্য সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করা যায় না। মনমোহনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দফতর তখন যুক্তি দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শুধু কয়লা মন্ত্রকের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর বসিয়েছিলেন। কিন্তু সিবিআইয়ের রিপোর্ট খতিয়ে দেখে আদালতের মত, ‘সুপরিকল্পিত ভাবে’ ওড়িশার তালাবিড়া-২ খনিটি হিন্দালকোকে পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল ও প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও কয়লা মন্ত্রকের একাধিক আমলা এর মধ্যে জড়িত ছিলেন। আদালতের মতে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর এ ব্যাপারে ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত সক্রিয়তা’ দেখিয়েছিল। কুমারমঙ্গলম বিড়লার চিঠি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বারবার কয়লা মন্ত্রককে চিঠি ও টেলিফোনে তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নিজের দফতরের দুই অফিসার কে ভি প্রতাপ ও জাভেদ উসমানির মত উপেক্ষা করে তদানীন্তন কয়লাসচিবের কথাতেই সায় দিয়েছিলেন মনমোহন। স্ক্রিনিং কমিটির সিদ্ধান্ত বাতিল করে কয়লা দেওয়া হয়েছিল হিন্দালকোকে। বিচারক ভরত পরাশর তাঁর নির্দেশে বলেছেন, “মনমোহন সিংহই নিজের হাতে কয়লা মন্ত্রক রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই প্রাথমিক ভাবে তিনি দাবি করতে পারেন না, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর পক্ষে সব মামলার খুঁটিনাটির দিকে নজর দেওয়া অসম্ভব।” তাঁর বক্তব্য, কয়লামন্ত্রী ও কয়লাসচিব যৌথ ভাবে হিন্দালকোকে ওই খনিটি পাইয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করছিলেন।

দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তলব করার যে অন্য তাৎপর্য রয়েছে, তা-ও তাঁর অজানা নয় বলে জানিয়েছেন বিচারক। তাঁর কথায়, “প্রাথমিক ভাবে প্রধানমন্ত্রীর জড়িত থাকার সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে বিবেকের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। দেশের মানুষের মনে এই নির্দেশ কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সে কথাও মনে রাখতে হয়েছে।” শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লা সম্পর্কে আদালতের নির্দেশে বলা হয়েছে, হিন্দালকোর চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি আমলা ও রাজনৈতিক স্তরে নিজের যোগাযোগের ফায়দা তুলেছিলেন। তাঁর হয়ে হিন্দালকোর অফিসাররা গোটা ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে আদালতের বক্তব্য। দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন হিন্দালকো কতৃর্পক্ষ। তবে আদালতের এই নির্দেশের জেরে আজ হিন্দালকোর শেয়ারের দর পড়েছে। বণিকসভা সিআইআই-এর তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘(আদালতের রায়ে) এই যে অনিশ্চয়তা তৈরি হল, তা বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা পাঠাবে।’ ইউপিএ জমানায় কয়লাখনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম তুলেছিলেন বিজেপি নেতা হংসরাজ আহির। আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আহির বলেন, “সব দোষীর শাস্তি হওয়া উচিত। ওই সব কয়লা খনি নিলাম করেই এখন প্রচুর অর্থ আসছে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement