State News

অরুণাচলে পদচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী কালিখো পুল আত্মঘাতী! বিক্ষোভ, কার্ফু

মাত্র পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চির কালিখো পুল মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ছিলেন প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস। তবে দীর্ঘ সময় অরুণাচলের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। বরাবর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ভরসার পাত্র ছিলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৬ ১৯:৫০
Share:

অন্ত্যেষ্টি মুখ্যমন্ত্রীর আবাসেই করার দাবিতে সরকারি কফিন পুড়িয়ে দিল স্থানীয় জনতা। নিজস্ব চিত্র।

মাত্র পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চির কালিখো পুল মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ছিলেন প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস। তবে দীর্ঘ সময় অরুণাচলের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। বরাবর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ভরসার পাত্র ছিলেন। কিন্তু তিনি যাঁদের উপরে ভরসা করে রাজ্যশাসনের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন, ছেড়েছিলেন দল, তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে পারলেন না আবেগপ্রবণ মানুষটি। আজ সকালে ইটানগরে মুখ্যমন্ত্রীর আবাসে তাঁর ঝুলন্ত দেহ মিলল।

Advertisement

গত মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পদ হারালেও মুখ্যমন্ত্রীর বাংলোতেই থাকছিলেন পুল। আজ ছিল তাঁর ‘বাড়ি’ ছাড়ার দিন। কিন্তু হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকা অরুণাচলের ‘প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী’ বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকেই। পুলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই কোনও দল বা সংগঠনের নেতৃত্বে নয়, সাধারণ মানুষই পথে নেমে বিক্ষোভে সামিল হন। ভাঙচুর করা হয় দুই মন্ত্রীর বাড়ি। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুলের জন্য আনা সরকারি কফিনও। আম জনতা দাবি তোলে, তাঁদের প্রিয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অন্ত্যেষ্টি মুখ্যমন্ত্রীর আবাসেই করা হোক।

১৯৬৯ সালে পুলের জন্ম। আনজাও জেলার কামান মিশমি উপজাতির সদস্য তিনি। ১৩ মাস বয়সে মা ও ছ’বছর বয়সে বাবাকে হারানো পুল আসবাব তৈরি করে, বেড়া বেঁধে পেট চালাতেন। জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আনলে মাসির বাড়ি এক বেলা খাওয়া জুটত। দারিদ্র্যের হতাশায় বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন বলে নিজেই স্বীকার করেছিলেন পুল। ১২ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণিতে পড়া পুলকে দেখে তৎকালীন জেলাশাসকের দয়া হয়। তাঁর সাহায্যেই মিডল স্কুলে ভর্তি হন পুল। কিন্তু টিউশন ফি দেওয়ার টাকাও ছিল না। তাই স্কুলেই নৈশ চৌকিদারের কাজ নেন। অষ্টম শ্রেণিতে ৪০০ টাকার বিনিময়ে বেড়া বেঁধে তাঁর ঠিকাদারি জীবন শুরু। সেখান থেকে ৩৭টি সরকারি ভবন, ১২টি সেতু ও কয়েকশো কিলোমিটার সড়ক তৈরি করা পুল স্নাতক হয়েই ১৯৯৫ সালে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়ান। ২৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ২২ বছর ধরেই তিনি ছিলেন মন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যের অষ্টম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন পুল।

Advertisement

গত বছর ডিসেম্বরে কংগ্রেসের ২১ জন সদস্য তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পুলকে তাঁদের নেতা নির্বাচন করেছিলেন। বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসি বিধায়কদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১০ বিজেপি ও নির্দল দুই বিধায়ক পুলকেই পরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন। অনাথ বা দরিদ্রদের জন্য বরাবরের সহানুভূতিশীল পুল জনতার দরবার শুরু করেন। সেখানে তাঁর কাছে এসে খালি হাতে কেউ ফিরত না। নিজের হেলিকপ্টার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রোগী আনার কাজে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সরকারি আবাস হয়ে উঠেছিল দরিদ্র রোগীদের আত্মীয়দের আশ্রয়স্থল। এমনকী দিল্লি গেলেও অরুণাচল ভবনে খবর নিয়ে দিল্লির হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেখে আসতেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। কার্যত এত দরদি ও কাজের মুখ্যমন্ত্রী আগে পায়নি রাজ্য। যে কোনও ছোটখাটো দুর্যোগেও চলে যেতেন ঘটনাস্থলে। তাই পুলের জনপ্রিয়তাও বাড়ে। তাঁকে কোনও দলের নয়, এই ক’মাসেই ‘মানুষের মুখ্যমন্ত্রী’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল অরুণাচলের আম-জনতা।

আরও পড়ুন: মণিপুর, আফস্পা এবং শর্মিলা চানুর অনশন: ফিরে দেখা...

গত মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জেরে ফের টুকির ক্ষমতা ফেরার পরেও পুলের আশা ছিল সঙ্গী বিধায়করা তাঁর সঙ্গেই থাকবেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভে তাঁর সঙ্গের বিধায়করা তাঁকে গুয়াহাটিতে একা ফেলেই ইটানগরে ফিরে কংগ্রেস শিবিরে যোগ দেয়। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হন পেমা খান্ডু। হতাশ পুল রাজ্যবাসীর স্বার্থে সব মেনে নেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠরা জানান, তার পর থেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

আজ মুখ্যমন্ত্রী আবাস ছেড়ে তাঁর চলে যাওয়ার কথা ছিল। বাড়িতে কেউ ছিলেন না। সকালে দেখা যায় শোয়ার ঘরের পাখার সঙ্গে পর্দার দড়ি গলায় বাঁধা পুলের দেহ ঝুলছে। পুলিশ প্রাথমিক ভাবে এটিকে আত্মহত্যার ঘটনাই বলছে। ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর, পুলের ঘরে একটি ডায়রিতে মৃত্যুর আগের অনেক লেখা ছিল। তা সরিয়ে ফেলেছে পুলিশ। তবে ডিজিপি এস নিত্যানন্দন জানান, ‘‘পুল একটি বিরাট লেখা রেখে গিয়েছেন। তা ঠিক সুইসাইড নোট নয়। তবে আমরা ওই লেখা এবং অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’’

এই সেই সিলিং ফ্যান। নিজস্ব চিত্র।

ঘটনা জানাজানি হতেই পথে নামে জনতা। সরকার পুলের জন্য নিম্নমানের কফিন এনেছে দাবি করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কফিন। মৃতদেহ বের করে আনতে পারেনি পুলিশ। পুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কংগ্রেসে ফেরা, বর্তমানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাওনা মেইন ও শিল্পমন্ত্রী তাপাং তালোর বাড়িও ভাঙচুর করে জনতা। ইটানগরে কার্ফু জারি করতে হয়। জনতা দাবি করে পুলের ডায়েরিতে থাকা সব নাম প্রকাশ করতে হবে। পরে বিরাট নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

পুলের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু বলেন, “এই ঘটনা আমার কাছে ব্যাপক ধাক্কা। রাজ্যের ইতিহাসে এত দয়ালু, সুদক্ষ নেতা কমই এসেছেন। রাজ্য পূর্ণ মর্য্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করবে। আগামী তিন দিন রাজ্যে শোকদিবস থাকবে।”

কংগ্রেস বরাবরই বলেছে, পুলকে বিপথে চালিত করেছে বিজেপি। নাবাম টুকি সব সময়ই পুলকে কংগ্রেসে থেকে, তাঁর পাশে থেকে কাজ করতে বলেছিলেন। কিন্তু অরুণাচল দখল করতে বিজেপি পুলকে সামনে রেখে এগোয়। পুল সৎ পথে রাজ্য চালাতে চেয়েছিলেন। তিনি কখনও বিজেপির হাতের পুতুল হতে চাননি। প্রদেশ বিজেপি সভাপতি তাপির গাও বারবার অমিত শাহের বার্তা পুলের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে সদলবলে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। কখনও বেঁধে দেওয়া হয়েছে সময়সীমাও। কিন্তু পুল ভাঙেননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement