বন্যার তোড়ে ভেঙে গিয়েছে জম্মু শহরতলির তাউই নদীর একটি সেতু।
ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে জম্মু ও কাশ্মীরের বন্যা পরিস্থিতি। জলস্তর ছুঁয়ে ফেলেছে তিনতলা উঁচু বাড়ি। ডুবে গিয়েছে শ্রীনগরের হাইকোর্ট, সচিবালয়। তলিয়ে গিয়েছে বাদামিবাগ অঞ্চলের সেনা ছাউনি। কার্যত নিশ্চিহ্ন রাজবাগ, সোনাওয়ার, কুরসু, নাতিপোরা, নওগাঁও ইত্যাদি এলাকা। শ্রীনগরের একটি শিশু হাসপাতালের দোতলা পর্যন্ত জলের নীচে। সব রোগী ও কর্মীকে উপরের তলায় সরানো হয়েছে। জল ঢুকে গিয়েছে শ্রীনগরের অন্য দু’টি হাসপাতালেও। আরও চার দিন ছুটি ঘোষণা হয়েছে রাজ্যের স্কুলগুলিতে।
প্রতি ঘণ্টায় অবনতি হচ্ছে অবস্থার। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০। নিখোঁজ বহু। ভেসে গিয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো গ্রাম। ঘরছাড়া আড়াই হাজার মানুষ। আজই উধমপুর জেলায় ধস চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের। রাজ্য জুড়ে বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিষ্ক্রিয় টেলিফোন। বন্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহও। বন্ধ হয়ে গিয়েছে জম্মু-পাঠানকোট সড়ক। ভেঙে গিয়েছে বেশ কয়েকটি সেতুও। কেবল বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জেগে রয়েছে কিছু স্থলভূমি।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সেনা ও বায়ুসেনার হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী। মজুত রয়েছে ২৩টি হেলিকপ্টার। এখনও পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছেন ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। গত কাল পুলওয়ামা জেলায় উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল ন’জন সেনাকর্মী-সহ একটি উদ্ধারকারী নৌকো। সাত জনকে উদ্ধার করা গিয়েছে, দু’জন এখনও নিখোঁজ। আজ বায়ুসেনার কপ্টারে উদ্ধার করা হয়েছে ১৮০ জন জলবন্দি জওয়ানকে। জম্মুতে ভারত-পাক সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন ছিলেন তাঁরা। উদ্ধারকারী দল জানিয়েছে, নৌকার অভাবে বেশ কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছতে পারছে না তারা।
গত পঞ্চাশ বছরে এত বড় দুর্যোগ ঘটেনি জম্মু ও কাশ্মীরে। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, উদ্ধারকাজ যাতে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে হয় তার দিকে যতটা সম্ভব নজর রাখছে প্রশাসন। শ্রীনগর, জম্মু ও নয়াদিল্লির মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য বসানো হচ্ছে কন্ট্রোল রুম। রাজ্যবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি। আশ্বাস দিয়েছেন, জম্মুতে জলস্তর ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করেছে।
গত কাল রাজনাথ সিংহের পরে আজ জম্মু ও কাশ্মীরে আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আকাশপথে বন্যা পরিস্থিতি ঘুরে দেখে জম্মু ও কাশ্মীর সরকারকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবারই বন্যায় মৃতের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা ও আহতের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মোদী। জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া হবে, যা দিয়ে কম্বল, দুধ, সৌরবাতি কিনে দুর্গতদের মধ্যে বিলি করা হবে। আজ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে একে ‘জাতীয় স্তরের বিপর্যয়’ বলে ব্যাখ্যা করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সঙ্গে বৈঠকও করেন। সেই সঙ্গে আরও এক হাজার কোটি টাকার বিশেষ ত্রাণের কথা ঘোষণা করেন মোদী।
শ্রীনগরে মালবাহী গাড়িতে করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পর্যটকদের।
কোমর পর্যন্ত জল পেরিয়েই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। শ্রীনগর সচিবালয়ের কাছে।
একই রকম বন্যা-বিধ্বস্ত ছবি প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও। মৃতের সংখ্যা দেড়শো পেরিয়েছে। এখনও পর্যন্ত ৯৭০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। বন্ধ হয়ে গিয়েছে সড়ক ও টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা। শনিবার পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাক মন্ত্রী ও এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে নওয়াজ শরিফকে একটি চিঠিও লিখেছেন নরেন্দ্র মোদী। মোদী জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের মতোই বিপর্যয় নেমে এসেছে পাকিস্তানে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে কোনও রকম সাহায্যের জন্য প্রস্তুত ভারত।
আবহবিদদের মতে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে ভারতে প্রবেশ করা পশ্চিমী ঝঞ্ঝাই এই বিপর্যয়ের কারণ। এই ঝঞ্ঝার প্রভাবে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে মৌসুমি বায়ু। আর তার জেরেই প্রবল বর্ষণ। সম্প্রতি পরপর বেশ কয়েকটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝার ধাক্কায় এই বিপর্যয় নেমেছে জম্মু-কাশ্মীরে। তবে এখানেই শেষ নয়। আরও একটি ঝঞ্ঝা আসার আশঙ্কা রয়েছে বলে আবহাওয়া দফতরের খবর।
আর তার ধাক্কায় বন্যার কবলে পড়তে পারে হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো প্রতিবেশী রাজ্যগুলিও। ক’দিন ধরেই ভারী বৃষ্টিপাত চলছে ওই দুই রাজ্যে। তাই জারি হয়েছে আগাম সতর্কতা।
রবিবার রয়টার্স ও পিটিআইয়ের ছবি।