মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।
অসমের সরকার থেকে বিরোধীপক্ষ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য নিয়ে এক সুরেই সমালোচনা করছে সবাই। এর মধ্যেই সে রাজ্যের দিসপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। ‘কৃষক শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ’-এর তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা করেছেন মমতা। সেই সঙ্গে অসমে জাতি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছে তারা।
অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) প্রথম খসড়া ঘিরে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বীরভূমের জনসভায় ঘোষণা করেন, ‘‘বাঙালিদের গায়ে হাত পড়লে আমি ছেড়ে কথা বলব না।’’
গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে এনআরসির প্রথম খসড়াটি প্রকাশ হয়েছে। প্রায় সওয়া তিন কোটি আবেদনের মধ্যে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের তথ্যপ্রমাণ যাচাই করার পর এই খসড়া তৈরি হয়েছে। এই ‘বিদেশি বাছাই’ নিয়ে সরব অসমের বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিভিন্ন বাংলাভাষী সংগঠন। মমতারও আশঙ্কা, এর পরে অসমের বাঙালিদের উপরে আঁচ পড়বে। এবং ‘‘অসম পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য। সেখানে গোলমাল হলে তার প্রভাব আমাদের রাজ্যেও পড়বে,’’ বলেছেন মমতা। কেন্দ্র ও অসমের বিজেপি সরকারের নাম না করেই এ দিন তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘আগুন নিয়ে খেলবেন না।’’
আরও পড়ুন: ছেড়ে কথা বলব না, মমতার হুঁশিয়ারিতে বিতর্ক
অসমের শাসক দল বিজেপি, বিরোধী দল কংগ্রেস-সহ অসমের সব দলের নিশানাতেই এখন মমতার এই মন্তব্য। বিজেপির তরফে বলা হয়, মমতা হয় নাগরিক পঞ্জি ব্যাপারটা বোঝেনই নি, না হলে ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এমন মন্তব্য করেছেন। বিজেপি মুখপাত্র রূপম গোস্বামীর মতে, মমতা নিজে ভোট ব্যাঙ্ক মজবুত করতে বাংলাদেশিদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় দিয়েছেন। এখন অসম বিদেশিমুক্ত রাজ্য তৈরির জন্য যে পদক্ষেপ করছে তা যদি বাংলাতেও লাগু হয় তাহলে দিদির ভোটব্যাঙ্ক শেষ হয়ে যাবে। সেই ভয়েই হয়ত এমন সব উক্তি। বিজেপির দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে হওয়া আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে এমন মন্তব্য খোদ সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা।
আরও পড়ুন: তিন তালাক বিলে নয়, মমতার আপত্তি পদ্ধতিতে
যে সংগঠনের করা অসম আন্দোলনের ফলশ্রুতি এনআরসি, সেই ‘আসু’র সাধারণ সম্পাদক লুরিণজ্যোতি গগৈয়ের মতে, “অসমের অস্তিত্বরক্ষা নির্ভর করে রয়েছে এনআরসির উপরে। অবৈধ ভাবে রাজ্যে বসবাসকারীদের চিহ্নিত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশে কাজ হয়েছে। একজন দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যক্তির এমন হঠকারী মন্তব্য করা অনুচিত। এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে রাজনীতি করা অন্যায়।”
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়া বলেন, “মনে হয় মমতাদেবী এনআরসি প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি ভাল করে জানেন না। তাঁকে সম্ভবত ভুল বোঝানো হচ্ছে। না হলে একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ও সর্বোচ্চ আদালতের নেতৃত্বে চলা এত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে এই ধরণের মন্তব্য করা থেকে তিনি বিরত থাকতেন। বিষয়টি তাঁকে ভাল করে বোঝানো দরকার।”
এআইইউডিএফ প্রধান বদরুদ্দিন আজমলের মতে, “একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে, কিছুই না জেনে এমন অপরিণামদর্শী, অবিবেচক মন্তব্য করা উচিত হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই এনআরসির কাজ চলছে।”
বিজেপি সভাপতি রঞ্জিৎ দাস বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এমন সব মন্তব্য করছেন জানি না। তবে তাঁর উস্কানি অসমকে অশান্ত করতে পারবে না। প্রয়োজনে রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবে।”
রাজ্যের বাঙালি সংগঠনগুলিও মমতাদেবীর মন্তব্যের নিন্দা করেছে। বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি দীপক দে বলেন, “যাঁরা প্রকৃত ভারতীয় তাঁদের নাম এনআরসিতে ঢুকবেই। খসড়ায় অনেকের নাম না থাকলেও পরবর্তী খসড়ায় ভারতীয়দের নাম আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস আছে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হওয়া উচিত। কিন্তু তার অন্যায্য চাপ অসমের উপরে পড়ুক সেটাও আমরা চাই না। নাগরিকপঞ্জি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হোন বা বাইরের অন্য কোনও নেতা-নেত্রীর অযথা হস্তক্ষেপ, উটকো মন্তব্য বা রাজনীতি করা থেকে বিরত থাকা উচিত। নাগরিকপঞ্জি বিদেশিমুক্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”
অসমের সেচমন্ত্রী রঞ্জিৎ দত্ত বলেন, বাংলাদেশিদের ভোটে গদি দখল করেছেন মমতা। অসম নিয়ে তাঁর কিছু বলার অধিকার নেই।
গোয়ালপাড়া ছাত্র সংগঠনের বক্তব্য, মমতা বাহুবলী নেত্রীর মতো আচরণ করছেন। সাহস থাকলে তিনি অসমে এসে মন্তব্য করুন।
বাঙালি সংগঠনগুলির মতে, মমতার মন্তব্য রাজ্যে বাঙালিদের অবস্থা আরও স্পর্শকাতর করে তুলেছে।
অসম গণ পরিষদের বিধায়ক সত্যব্রত কলিতা বলেন, “এমন মন্তব্য করে অসমে আগুন লাগানোর চেষ্টা করবেন না। এনআরসি নিয়ে এ রাজ্যের বাঙালিদের কোনও চিন্তা নেই, মমতার এত মাথাব্যথা কেন?”
আসুর উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলেন, “এর আগে বাম আমলেও বাংলার সরকার অসম আন্দোলনকে না বুঝে নিন্দনীয় মন্তব্য করেছিল। তৃণমূলও একই পথের পথিক। মমতাদেবীর জানা উচিত, এনআরসি প্রক্রিয়ায় কোনও জাতিগত বা ভাষাগত ভেদ নেই। এটি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে চলা আইনি প্রক্রিয়া। অসম চুক্তির ফলশ্রুতি স্বরূপ অসমকে বিদেশিমুক্ত করার জন্যই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে। কোনও একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার জন্য এই কাজ চলছে না। তার মধ্যে বিজেপি, অগপ, কংগ্রেস, তৃণমূলের কোনও রাজনৈতিক কাজিয়ার স্থান নেই।”