কোনও অবিবাহিত মা একাই তাঁর সন্তানের পূর্ণ অভিভাবক হতে পারেন। তার জন্য জন্মদাতা বাবার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়— এমনটাই জানিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। বিশেষ ক্ষেত্রে বাবার পরিচয় জানাতেও মা বাধ্য নন বলে মনে করছে সুপ্রিম কোর্ট।
বিচারপতি বিক্রমজিৎ সেন এবং বিচারপতি অভয়মনোহর সাপ্রের বেঞ্চের মতে, পিতৃপরিচয়ের তুলনায় সন্তানকে ভাল রাখার দিকটিই সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই বিবেচনাতেই এক অবিবাহিত মায়ের অভিভাবকত্বের আবেদনে সাড়া দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তাঁকেই অভিভাবক বলে ঘোষণা করা হোক। প্রথমে ওই মহিলা নিম্ন আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সেখানে তাঁর আর্জি খারিজ হয়ে যায়। শীর্ষ আদালত কিন্তু তাঁর ইচ্ছাকেই স্বীকৃতি দিল।
আবেদনকারিণীর পরিচয় গোপন রেখে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, ওই অবিবাহিত খ্রিস্টান মহিলা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ২০১০ সালে। তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত এবং ভাল চাকরি করেন। ছেলের জন্মের পর থেকে তিনি একাই সব দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। জন্মদাতা বাবার কোনও সাহায্যই পাননি। কিছু বিমা এবং সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ছেলেকে ‘নমিনি’ করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানান— হয় তাঁকে ছেলের বাবার নাম জানাতে হবে, নইলে কোর্টের কাছে থেকে অভিভাবকত্বের শংসাপত্র জোগাড় করতে হবে। তখনই ওই মহিলা তাঁর সন্তানের পূর্ণ অভিভাবকত্ব চেয়ে আদালতে (গার্ডিয়ান কোর্ট) আর্জি জানান। কিন্তু সেখানেও তাঁকে ছেলের বাবার নাম এবং অন্যান্য তথ্য জানাতে বলা হয়। কিন্তু মহিলা রাজি হননি। তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। সেটা ২০১১ সালের ঘটনা।
এর পরে ওই মহিলা দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর আর্জি নাকচ হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টে মামলা আসার পরে আদালত জানতে পেরেছে, ওই মহিলার সন্তানের জন্মদাতা এখন অন্য মহিলাকে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। ফলে অভিভাবকত্বের প্রশ্ন তুললে এখন সেই পরিবারেও প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া মহিলা নিজে স্বীকার করেছেন, ওই ভদ্রলোক তাঁর এই সন্তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিতই নন। ওঁরা দু’জন মাত্র দু’মাস একসঙ্গে ছিলেন। ফলে অভিভাবকত্বের কোনও দাবি ওই জন্মদাতার তরফ থেকে ওঠার কথা নয়। মহিলার আরও প্রশ্ন ছিল, পাসপোর্ট আবেদনের ফর্মে যদি বাবার পরিচয় জানানো বাধ্যতামূলক না হয়, তা হলে অভিভাবকত্ব বিচারের ক্ষেত্রেই বা কেন বাধ্যতামূলক হবে?
সুপ্রিম কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, শিশুর ভাল ভাবে বড় হয়ে ওঠাটাই গুরুত্বপূর্ণ। কোনও অবিবাহিত মা যদি সন্তানের বাবার নাম গোপন রাখতে চান, তা হলে আদালতও তাঁকে সে ব্যাপারে জোর করতে পারে না। শীর্ষ আদালত সহজ করতে চেয়েছে শিশুর জন্মের শংসাপত্রের দিকটিও। প্রশাসনিক জটিলতা প্রথম থেকেই লঘু করার জন্য সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, ‘‘কোনও অবিবাহিত মা তাঁর গর্ভের সন্তানের জন্য জন্মের শংসাপত্রের আবেদন জানালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছ থেকে শুধু একটি হলফনামা চাইতে পারে। তার পরে শংসাপত্র দিতে তারা বাধ্য।’’
একাকী মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, আজকের সমাজে যখন মহিলারা নিজের সন্তানকে একাই বড় করে তোলার দায়িত্ব নিচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে কোনও অনিচ্ছুক ব্যক্তিকে এর মধ্যে জড়ানোর মানে হয় না। আমরা মনে করি, যে বাবা তাঁর দায়িত্ব নিজেই ঝেড়ে ফেলতে চান, সন্তানের মঙ্গলের জন্য সেই বাবাকে দরকার নেই।
আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই একাকী মহিলারা নিজ দায়িত্বে সন্তানের জন্ম দিতে চাইছেন অথবা সন্তান দত্তক নিচ্ছেন। আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হওয়ার জন্য এগিয়ে আসছেন অবিবাহিত মহিলারাও। যেমনটা দেখা গিয়েছিল ওনিরের ছবি ‘আই অ্যাম’-এ। সেখানে একটি গল্পে অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ বিবাহবিচ্ছেদের পরে মা হতে চেয়েছিলেন আইভিএফ পদ্ধতিতে। সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায়ে এই মহিলারাও সন্তানের অভিভাবকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা কাটাতে পারবেন কি? প্রবীণ আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের মত সে রকমই। তাঁর কথায়, ‘‘আজকের রায়ের ফলে যে একাকী মেয়েরা সন্তান দত্তক নিতে চান বা বিবাহবিচ্ছিন্না মেয়েরা, যাঁরা একার দায়িত্বে সন্তান মানুষ করছেন, তাঁরা সকলেই উপকৃত হবেন।’’
এ শহরে একাকী মায়েদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত মুখ চিত্রশিল্পী ইলিনা বণিক। তিনি বিবাহবিচ্ছিন্ন হওয়ার বেশ কিছু বছর পরে সন্তানের জন্ম দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। বেছে নিয়েছিলেন আইভিএফ। এখন তাঁর মেয়ে অমরাবতীর বয়স তিন। ইলিনা বললেন, ‘‘আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হতে চেয়ে প্রথমে বাধা পেয়েছিলাম স্বনামধন্য চিকিৎসকদের কাছেই। নীতি পুলিশের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁদের। পরে ২০১২-য় অবশ্য এখানকার চিকিৎসকের সাহায্য নিয়েই সন্তানের জন্ম দিয়েছি।’’
কেন ইলিনাকে প্রথমে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার খানিকটা আভাস পাওয়া গেল চিকিৎসক সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের কথায়। তিনি জানালেন, এত দিন বিভিন্ন ইনফার্টিলিটি সেন্টারগুলি এই সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিত নিজস্ব ‘এথিকাল কমিটি’র মাধ্যমে। তাঁরা ওই মেয়েটির শারীরিক-মানসিক অবস্থা, সামাজিক নিয়ম, সর্বোপরি শিশুটির কল্যাণের বিষয়টি বিচার করে সিদ্ধান্ত নিত। সুদর্শনবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমাদের বিশ্বাস ছিল, এই আইন এক দিন হবে। কারণ জননের অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। আইনি স্বীকৃতির ফলে এ বার মাতৃত্ব নিয়ে বেআইনি কারবারেও রাশ টানা যাবে।’’
ইলিনা অবশ্য এখনও সব বাধা পেরোতে পারেননি। বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে তার বাবা কে, এই প্রশ্নটা শুনতেই হচ্ছে। রায়কে স্বাগত জানিয়ে তাই ইলিনা বলছেন, এ বার হয়তো পথটা একটু সহজ হবে। আর এক একাকী মা, চিত্রপরিচালক অনিন্দিতা সর্বাধিকারী বললেন, ‘‘খুব আবেগতাড়িত লাগছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন এমন অধিকারের স্বীকৃতি দেয়, তখন মনে হয় দেশ সত্যিই এগোচ্ছে।’’
মহাভারতে কুমারী মা কুন্তী নিজের সন্তান কর্ণকে কাছে রাখতে পারেননি। কর্ণ সূতপুত্র হিসেবে বড় হন। শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত সুপারহিট ছবি ‘আরাধনা’য় দেখা গিয়েছিল, সন্তানকে অন্য একটি পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছেন অবিবাহিত মা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সব কাহিনি অতীত হয়ে গেল আজ। বরং অভিনেত্রী নীনা গুপ্ত যে ভাবে সব রকম সামাজিক বাধা জয় করে নিজের মেয়ে মাসাবাকে বড় করেছেন, সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, আজকের রায় সেই অধিকারকেই আইনি সিলমোহর দিল।