যোজনাই বহির্ভূত

ইতিহাসের ইতি

বিদায়, যোজনা কমিশন। দিল্লির সাবেক বাবুতন্ত্রের অন্যতম প্রতীক অ্যাম্বাসাডর গাড়ির শেষের ঘণ্টা বেজেছে এই সে দিন। এ বার সোভিয়েত যুগের নিদর্শন যোজনা কমিশনের পালা। গত কাল লালকেল্লা থেকে তাঁর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, যোজনা কমিশনের বদলে শীঘ্রই তৈরি হবে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। অর্থ বরাদ্দ আর উন্নয়ন প্রকল্পের নকশা তৈরি যার কাজ হবে না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫৫
Share:

বিদায়, যোজনা কমিশন।

Advertisement

দিল্লির সাবেক বাবুতন্ত্রের অন্যতম প্রতীক অ্যাম্বাসাডর গাড়ির শেষের ঘণ্টা বেজেছে এই সে দিন। এ বার সোভিয়েত যুগের নিদর্শন যোজনা কমিশনের পালা। গত কাল লালকেল্লা থেকে তাঁর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, যোজনা কমিশনের বদলে শীঘ্রই তৈরি হবে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। অর্থ বরাদ্দ আর উন্নয়ন প্রকল্পের নকশা তৈরি যার কাজ হবে না। কাজ হবে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার জোগান দেওয়া।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ভাবনা ধার করে ১৯৫০ সালে যোজনা কমিশন গঠন করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। তিনিই হয়েছিলেন প্রথম চেয়ারম্যান। তার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীরাই বসেছেন যোজনা কমিশনের মাথায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উপযোগিতা যে কমে এসেছে, তা উপলব্ধি করেছেন একাধিক প্রধানমন্ত্রী। কমিশন ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছেন কেউ কেউ। যেমন, রাজীব গাঁধীই যোজনা কমিশনকে ‘সাদা হাতি’ বলেছিলেন। এমনকী, কমিশনের সদস্যদের ‘এক পাল ভাঁড়’ আখ্যা দেন বলেও দাবি কারও কারও। মনমোহন সিংহ তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান।

Advertisement

সংসদ মার্গে যোজনা কমিশনের বাড়িটা যে আসলে অকর্মণ্য আমলাদের বৃদ্ধাশ্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে বুঝেছিলেন মনমোহন নিজেও। গত মার্চে কমিশনের বৈঠকে সেটা বলেওছিলেন তিনি। তাঁর মত ছিল, সময়ের সঙ্গে বদলাতে হবে যোজনা কমিশনকে। কিন্তু সেই বদলের গতি ছিল নেহাতই শ্লথ। কমিশনের বিদায়ী সদস্য সঈদা হামিদের কথায়, “দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকারের জমানায় বারবার যোজনা ভবনে আলোচনা হয়েছে, কমিশনের আকার বদলের সময় এসেছে কি না, তা নিয়ে। নীল নকশা তৈরি হয়েছে।” কিন্তু কিছুরই রূপায়ণ হতে দেখা যায়নি। তার বদলে মনমোহন সিংহের আমলে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন হয়ে কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই বাড়িয়ে ফেলেন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া। যোজনা কমিশনের সঙ্গে নানা মন্ত্রকের সংঘাত বাধে। যোজনা কমিশনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আরও বেশি করে।

এই অবস্থায় শুক্রবার সকালে এক ধাক্কায় জুরাসিক যুগের অবসান ঘটালেন নরেন্দ্র মোদী। বললেন, “কখনও কখনও পুরনো বাড়ি মেরামতে খরচ বেশি পড়ে, অথচ আমরা তাতে সন্তুষ্টও হই না। তাই আমাদের মনে হয়, সবাই মিলে একটা নতুন বাড়ি তৈরি করলেই ভাল।” যে ঘোষণাকে নব্বইয়ের দশকে লাইসেন্স রাজ অবসানের পরে সবচেয়ে বড় সংস্কার হিসেবে দেখা হচ্ছে। কমিশনের বিদায়ী সদস্য অরুণ ময়রার কথায়, “যোজনা কমিশন বদলাচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু দ্রুত গতিতে নয়। এই কাজ বলে বলে করানো যেত না। এক ঝটকায় করতে হতো। মোদী তাই করেছেন।”

বিরোধীরা অবশ্য মোদীর ঘোষণা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের কথায়, “যোজনা কমিশন তুলে দিতে চাইলে আবার আলাদা সংস্থা গড়ার কথা বলা হচ্ছে কেন! এটা কি তা হলে নিছকই নাম বদল? যোজনা কমিশনের কাজই করবে নতুন সংস্থা?”

যোজনা কমিশনের কাজ কী ছিল?

এক কথায়, উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাবদ অর্থের জোগান এবং কোথায়, কোন ক্ষেত্রে সেই অর্থ খরচ করা প্রয়োজন এই দু’টিকে মিলিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ এক দিকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করে বিভিন্ন রাজ্য বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের জন্য অর্থ বরাদ্দ। অন্য দিকে উন্নয়নমুখী প্রকল্পের নকশা তৈরি। কিন্তু নেহরুর যুগে প্রায় সবটাই ছিল সরকারি বিনিয়োগ। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কোথায় ইস্পাত কারখানা বসাবে, কোথায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করবে, তা যোজনা কমিশনই ঠিক করে দিত। কিন্তু ’৮০ থেকে ’৯০-এর দশকে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করল। কমতে থাকল যোজনা কমিশনের ভূমিকাও।

সোভিয়েত ইউনিয়নে উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরির কাজটি করত ‘গসপ্ল্যান’। যা দেখেই নেহরুর মাথায় যোজনা কমিশনের ভাবনা আসে। সোভিয়েতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ‘গসপ্ল্যান’-ও উঠে যায়। বিশ্বের বহু দেশেই যোজনা কমিশন বলে কোনও বস্তু নেই। কারণ সেখানে বেসরকারি বিনিয়োগই এখন প্রধান বিনিয়োগ। এমনকী চিনেও যোজনা কমিশন চরিত্র বদলেছে, নামও। সে দেশের ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশন’ এখন ত্রয়োদশ যোজনা তৈরির কাজ করছে। মূলত তার কাজ হল, যেখানে উন্নয়নের অভাব রয়েছে, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে তৈরি প্রকল্পগুলি সেখানে নিয়ে যাওয়া।

মোদীর প্রস্তাবিত নতুন প্রতিষ্ঠানও অনেকটা এই পথেই চলবে বলে মনে করা হচ্ছে। মোদী বলেন, নয়া প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার জোগান দেওয়া। মোদী ক্ষমতায় আসার পরই যোজনা কমিশনের অধীনস্থ স্বাধীন মূল্যায়ন দফতরের সুপারিশও তেমনটাই ছিল। বলা হয়েছিল, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তার রূপরেখা বাতলানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক নতুন সংস্থার ভূমিকা।

এত দিন উন্নয়নের অর্থ চাইতে ফি বছর মুখ্যমন্ত্রীদের যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দরবারে আসতে হতো। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “সময় পাল্টেছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে রাজ্যগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে।” যার অর্থ স্পষ্ট। আগামিদিনে অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই বদলে যাবে।

প্রস্তুতি আগে থেকেই চলছে। সরকারি সূত্র বলছে, এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন সংস্থার বিষয়ে ঘোষণা হবে। বুধবার ক্যাবিনেট সচিবালয়ে যোজনা কমিশনের সচিব সিন্ধুশ্রী খুল্লারকে ডেকে পাঠানো হয়। অনেক রাত পর্যন্ত বৈঠক চলে। বৃহস্পতিবারও বৈঠক হয়েছে।

মনে করা হচ্ছে, আমেরিকায় অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের নিয়ে যেমন পরিষদ রয়েছে, নতুন সংস্থার ধাঁচ হবে অনেকটা সেই রকম। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, নতুন সংস্থার নাম হবে ‘ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশন’। কিন্তু চিনেও একই নামের সংস্থা রয়েছে। তাই অন্য নাম নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। নতুন সংস্থার মাথায় আসতে পারেন সুরেশ প্রভু। যিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সংস্কারে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। নাম রয়েছে প্রাক্তন বিলগ্নিকরণ মন্ত্রী অরুণ শৌরিরও।

• আর্থিক পরিকল্পনার কথা প্রথম ভাবেন সুভাষচন্দ্র বসু, ১৯৩৮ সালে। যার খসড়া তৈরি করেন মেঘনাদ সাহা।

• পরাধীন ভারতেই ১৯৪৪ সালে পরিকল্পনা বোর্ড তৈরি করে ব্রিটিশরা। ১৯৪৬ পর্যন্ত তিনটি পরিকল্পনা তৈরি হয়। যোজনা কমিশনের যাত্রা শুরু ১৯৫০-এর ১৫ মার্চ। সরকারি নির্দেশ জারি করে এটি গড়েন জওহরলাল নেহরু।

• ১৯৫১ সালে ঘোষিত হল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা।

• পরের দু’টি পরিকল্পনা ১৯৫৬ ও ১৯৬১ সালে।

• ১৯৬৬-তে পরিকল্পনা ঘোষণা স্থগিত রইল ভারত-পাক যুদ্ধের আবহে। তার পরের দু’বছরও।

• পঞ্চম পরিকল্পনার (১৯৭৪-১৯৭৯) মেয়াদ বাড়ানো হয় এক বছর। ষষ্ঠ পরিকল্পনা শুরু হল ১৯৮০-তে।

• রাজনৈতিক টালমাটালের কারণে পরিকল্পনা রচনা করা হয়নি ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালেও।

• ২০১২ সালে শেষ হয়েছে একাদশ পরিকল্পনার মেয়াদ।

• ১৫ অগস্ট ২০১৪, যোজনা কমিশনের অবলুপ্তি ঘোষণা করলেন নরেন্দ্র মোদী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement