চারিদিকে ফাটল, আতঙ্কে কাঁপছে বিধ্বস্ত ইম্ফল

আগেও অনেক বার এসেছি পাহাড় ঘেরা এই শহরে। কিন্তু ভোরের তীব্র কম্পনের ধাক্কায় ত্র্যস্ত ইম্ফল বেলা দেড়টাতেও সেই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। হবেই! স্বাধীনতার পরে এই দ্বিতীয় বার এত বড় ধাক্কা। ১৯৫০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে কেটে গিয়েছে সাত দশক। এর মধ্যে খুচরো কম্পন অনেক হলেও এত বড় ভূমিকম্পের নাড়া এই প্রজন্ম খায়নি। তাই কম্পনের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়েও আশঙ্কা আর আলোচনাতেই দিন কাটল ইম্ফলের।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

ইম্ফল শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:২৮
Share:

আগেও অনেক বার এসেছি পাহাড় ঘেরা এই শহরে। কিন্তু ভোরের তীব্র কম্পনের ধাক্কায় ত্র্যস্ত ইম্ফল বেলা দেড়টাতেও সেই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। হবেই! স্বাধীনতার পরে এই দ্বিতীয় বার এত বড় ধাক্কা। ১৯৫০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে কেটে গিয়েছে সাত দশক। এর মধ্যে খুচরো কম্পন অনেক হলেও এত বড় ভূমিকম্পের নাড়া এই প্রজন্ম খায়নি। তাই কম্পনের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়েও আশঙ্কা আর আলোচনাতেই দিন কাটল ইম্ফলের।

Advertisement

অন্য সময়ে সন্ত্রাস-বিধ্বস্ত এই শহরের বিমানবন্দরে নামলেই সামরিক পোশাক আর কালাশনিকভের কড়া নজর থাকত যাত্রীদের উপরে। রানওয়েতে নেমে ক্যামেরা বের করা তো দূরের কথা, তুলিহাল বিমানবন্দরের বাইরে থেকে বিমানবন্দর ভবনের ছবি তুললেও তাড়া খেতে হয়েছে। কিন্তু আজ বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরাই তো আশপাশের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। মূল ভবনের চূড়ায় বিরাট ফাটল বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। ফাটলের স্পষ্ট চিহ্ন আশপাশের দেওয়ালেও। উত্সাহী যাত্রীদের অনেকেই মোবাইল বের করে যথেচ্ছ ছবি তুললেন বিমান থেকে নেমেই। কেউ ধমকালেন না।

সাধারণত বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই অটোচালকদের চেনা প্রশ্ন ধেয়ে আসে— হোটেল? আজ সাংবাদিক দেখে তাঁরাই হাঁকছেন, হসপিটাল? আর্থকোয়েক? ভোর ৪টে ৩৫ মিনিটের ৬.৮ রিখটার স্কেলের তীব্র কম্পনের পরে ৩.৫ রিখটার স্কেলের আরও দু’টি আফটার শকে কেঁপেছে ইম্ফল। তাই অটোওয়ালারাও জানেন, গন্তব্য আজ বদলাতে বাধ্য।

Advertisement

শহরের দিকে আসতেই নজরে পড়তে থাকে বিভিন্ন স্থানে ফাটলের চিহ্ন। মেনুথাং সেতুতে আড়াআড়ি বিরাট ফাটল। সেখানে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে থঙ্গল বাজার আর ইমা কাইথেল। ইমা হল এশিয়ার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে পুরনো মহিলা পরিচালিত বাজার। অন্য দিনের জমজমাট কেনাবেচা আজ উধাও। বাজারের ২ ও ৩ নম্বর ভবনে বিরাট ফাটল। সে দিকে তাকিয়ে মহিলাদের জটলা। সরানো হচ্ছে মালপত্র। থামগুলি ভেঙে বেরিয়ে এসেছে লোহার খাঁচা। মণিপুর ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির ভবন এবং বিএসএনএল ভবনের প্রথম তলেও ফাটলের চেহারা ভয় ধরানো। আশপাশের এলাকায় সকাল থেকে বিদ্যুত্ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে।

তামেংলংয়ের বাসিন্দা সিলভিয়া, থৌবালের ডেভিডরা আপাতত ইম্ফলে। ভোরের আতঙ্কের রেশ এখনও তাঁর গলায়। বলছিলেন, ‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম রাস্তার পাশেই বাড়ি। বড় ট্রাক যাওয়ায় হয়তো বাড়ি কাঁপছে। কিন্তু ভুল ভাঙতেই বাড়ির সকলকে টেনে কোনওমতে রাস্তায় এসে নেমেছি।’’ ইম্ফলে রাতের তাপমাত্র এখন নেমে যাচ্ছে ৫ ডিগ্রিতে। ভয়ের চোটে ঠান্ডার কামড় টের পাননি সিলভিয়া, ডেভিডরা। তামেংলং-সহ বহু প্রত্যন্ত এলাকায় টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই সেখানকার খবর না পেয়ে ইম্ফলের আত্মীয়রা দুশ্চিন্তায়।

অটো পৌঁছয় প্রেস ক্লাবে। আশপাশের বাড়িই শুধু নয়, খোদ প্রেস ক্লাবের নবনির্মিত বহুতল ভবনের একতলার দেওয়াল জুড়ে কেবল ফাটলের চিহ্ন।

রিমস হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু সে দিকে তাকানোর সময় কোথায়? সকাল থেকে একের পর এক গাড়ি ঢুকছে হাসপাতালে। নিয়ে আসা হচ্ছে জখমদের। কারও মাথায় ভেঙে পড়েছে ছাদ, কারও পা ভেঙে ঝুলছে, কারও ফাটা মুখ হাসপাতালের বারান্দাতেই সেলাই করতে শুরু করেছেন নার্সরা। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বেলা ১২টা অবধি সেখানে ভর্তি থাকা জখমের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। হাসপাতালে জখমদের দেখতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘এত বড় বিপর্যয় আগে দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করে খবর নিয়েছেন।’’ জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দু’টি দল ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছেছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সব জেলাশাসককে যুদ্ধকালীন তত্পরতায় ত্রাণশিবির খুলতে বলা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ক্ষয়ক্ষতির খবর সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিহতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও প্রথম সুযোগেই ঘোষণা করেছেন ইবোবি সিংহ।

ভূমিকম্পের পরেও আজ সকালে ইম্ফলে নিয়মমাফিক স্কুল-কলেজ খুলেছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে রাজ্যের সব স্কুল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্য দিন রাজ্যের দারিদ্রের জন্য সরকারকে গাল পাড়েন এখানকার মানুষ। আর এ দিন স্থানীয় ব্যবসায়ী এন ববিচাঁদ বলছিলেন, ‘‘গরিব হওয়াতেই বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচল মণিপুর।’’ উল্লেখ্য, যে এলাকায় কম্পনের মূল কেন্দ্র, সেই তামেংলং-নোনে মূলত গ্রাম। জঙ্গল এবং পাহাড় ঘেরা ছোট জনপদ। ৯৯ শতাংশই কাঁচা বাড়ি হওয়ায় সেখানে কেউই মারা যাননি। নিহতের সংখ্যা মাত্র এক। এবং জখম ৪।

ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে শহরে। তবে ইম্ফলে চারতলার বেশি উঁচু বাড়ি কমই আছে। এর মধ্যে একটি নির্মীয়মাণ চারতলা বাড়ি পুরোপুরিই ভেঙে পড়েছে। গাড়ির উপরে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনাও শহরে বেশ কয়েকটি ঘটেছে। থৌবালের ইয়াইরিপোক বাজারের ১০টি থাম ভেঙেছে। সদর হিলে ভেঙেছে এক বিধায়কের বাড়িও। অবশ্য ইম্ফলের ঐতিহাসিক কাংলা দুর্গের কোনও ক্ষতি হয়নি আজ। ভিতরে গোবিন্দজির মন্দিরও অক্ষত।

বিস্ফোরণ, জঙ্গি-পুলিশ লড়াইয়ের সঙ্গে নিত্য ঘর করেন ইম্ফল তথা মণিপুরের মানুষ। কিন্তু আজকের দিনটা ছিল একেবারে অন্য রকম। এমন ভয় ঢুকেছে মানুষের মনে, যার সমাধান বন্দুকের নলও করতে পারে না। লেইমাখং সেনা ছাউনিতে যাওয়ার পথে বিরাট ফাটল। তেমনই মায়ানমার সীমান্তে থাকা জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা উপ-মুখ্যমন্ত্রী গাইখংবাম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে তাঁদের অসহায়তার কথা মেনে নিয়েছেন।

কাংলার পিছনে সূর্য ঢলছে। এখনও রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে আসছে ক্ষয়ক্ষতি আর জখম মানুষের খবর। অন্তত একটা দিনের জন্য নিজেদের মধ্যে না লড়ে মণিপুরের সেনাবাহিনী ও জঙ্গিরা প্রকৃতির হামলার বিরুদ্ধে লড়ছেন। দু’পক্ষের লক্ষ্যই এক, দুর্গতদের উদ্ধার করা।

ছবি: বাপি রায়চৌধরী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement