রক্তাক্ত নিস। ছবি: রয়টার্স।
পৌঁছে যাও ‘কাফের’-এর দোরগোড়ায়। আঘাত হানো সর্বশক্তি দিয়ে। প্রয়োজনে একলাই। যেমনটি আজ করে দেখালো তিউনিশিয়ার যুবকটি।
ইস্তানবুল থেকে অরল্যান্ডো। ঢাকার গুলশন থেকে আজ ফ্রান্সের নিস। তৈরি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের ব্যাকরণে এত দিন না-থাকা একটি প্রথাবহির্ভূত ব্র্যান্ড। যার পোশাকি নাম ‘লোন উলফ’। ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। সর্বত্র লোন উলফ মডেলের এই প্রয়োগ কার্যত সূত্রহীন করে তুলেছে ভারতীয় নিরাপত্তা কাঠামোকে। কারণ কবে, কোন দিক থেকে, কারা, কী ভাবে ভারতের অভ্যন্তরে এই ধরনের হামলা চালাবে তার আগাম আন্দাজ পাওয়া কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা।
কী এই ‘লোন উলফ’ মডেল যার মোকাবিলায় রাতের ঘুম ছুটেছে গোয়েন্দাদের?
সেটি হল, যেখানে দলীয় সংগঠন অনুপস্থিত, সেখানে এক বা দু’জনই হামলা চালাবে ‘বিধর্মী’দের উপর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এক কর্তার মতে, ‘‘এই হামলার কোনও নির্দিষ্ট নকশা নেই। সুনির্দিষ্ট ভূগোল নেই। কিছু হামলার পিছনে আইএস-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে কোনও এক বা দুই ব্যক্তি, নিজস্ব মৌলবাদী মনোভাবের কারণে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। যেমনটা দেখা গিয়েছে গুলশনে।’’ দেখা যাচ্ছে, আইএস-এর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সুদর্শন যুবকেরা বেছে বেছে হত্যা করে বিদেশি ‘কাফের’ নাগরিকদের। ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হিসাবে অর্ল্যান্ডোতে যে ভাবে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল আফগানিস্তানের ওমর মতিন। আইএস ভাবধারায় বিশ্বাসী এই যুবকের মগজ ধোলাইয়ের পিছনে কারা ছিল তা খুঁজতে এখনও কালঘাম ছুটছে মার্কিন গোয়েন্দাদের।
আরও পড়ুন:আবার রক্তাক্ত ফ্রান্স, উৎসবের নিসে ‘জঙ্গি’ ট্রাক পিষে মারল ৮৪ জনকে
সন্ত্রাসের নতুন এই মডেলটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ত্রাসের কারণ এ কারণেই যে যেখানে দলের উপস্থিতি থাকে সেখানে তাদের সূত্র পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু যেখানে গোটা পরিকল্পনাটাই এক জনের মস্তিষ্কপ্রসূত সেখানে সূত্র খোঁজা কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছেন সব দেশের গোয়েন্দারা। আজ যে মডেলে আঘাত হানা হয়েছে নিস-এ।
ভারতে এই ধাঁচের হামলা এখনও না হলেও যে ভাবে এ দেশে আইএস-এর প্রভাব বাড়ছে, যুবকেরা যেখানে দলে দলে উধাও হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কত দিন এই বিপদ ভারতে অচেনা থাকবে তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে। গত সপ্তাহেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ধরা পড়েছে আইএস জঙ্গি মুসা। যার উপর দায়িত্ব ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানোর। হায়দরাবাদে ধরা পড়েছে আইএস মডিউল। চলতি সপ্তাহেই কেরল ছেড়ে সিরিয়ায় আইএসে যোগ দিতে ভারত ছেড়েছে ১৭ জন যুবক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রের খবর, ওই যুবকেরা সিরিয়ায় আইএস-এর ঘাঁটিতে পৌঁছে গিয়েছে। পৌঁছে গিয়ে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আশঙ্কা, জঙ্গি প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর এরা যদি নেপাল বা বাংলাদেশ সীমান্তের ফাঁক গলে ভারতে ঢুকে এসে নাশকতা চালিয়ে নিজেদের ধ্বংস করে দেয়, সে ক্ষেত্রে কী ভাবে তা রোধ করা সম্ভব? উত্তর নেই কর্তাদের কাছে। ধারাবাহিক আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা তথ্যই একমাত্র ভরসা। তার মাধ্যমে আগাম যতটা হামলা ঠেকানো সম্ভব হয়।
লোন উলফ মডেলটির বাড়বাড়ন্তের পিছনে কারণ কী?
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজেদের গড় সিরিয়ায় ক্রমশ জমি হারাচ্ছে আইএস। লাগাতার আমেরিকা ও রাশিয়ার হানায় গত ছ’মাসে নিজেদের অধিকারে থাকা ১২ শতাংশ জমি হারিয়েছে আইএস। টান পড়েছে উপার্জনেও। এ যাবৎ তেল ও প্রত্নসামগ্রী বেচে বিপুল অর্থ ভাঁড়ারে জমা করেছিল আইএস। কিন্তু রাশিয়া আইএস-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার পর থেকেই পিছু হঠা শুরু হয় আইএস-এর। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে বেতন অর্ধেক করে দিতে হয়েছে জিহাদিদের। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, গত বছর এই সময়ে যখন ৩৩ হাজার সশস্ত্র জঙ্গি ছিল সিরিয়াতে এখন তা কমে ১৮ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।
এই কমে আসা সংখ্যার একটা কারণ যদি হয় সংঘর্ষে মৃত্যু, তা হলে দ্বিতীয় কারণটি হল নেতিবাচক পরিস্থিতিতে জঙ্গিদের ঘরে ফিরে আসা। তবে এই ‘ঘরে ফেরা’ই এখন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য। গত ২১ মে আইএস-এর মুখপাত্র আবু মহম্মদ আল আদনানি একটি বার্তায় জানায়, ‘‘আমাদের এখন গেরিলা আক্রমণের উপর জোর দিতে হবে।” আইএস মনোভাবাপন্ন যুবকদের প্রতি তার আহ্বান, “যখন যেখানে ‘শত্রু’ নিকেশের সুযোগ পাবে সেখানেই হামলা চালাও।”
‘কখন’ এবং ‘কোনখানে’— এই প্রশ্নকে ঘিরেই আতঙ্ক বাড়ছে নয়াদিল্লির।