National News

মমতা-কেজরীর লক্ষ্য এক, কিন্তু রাস্তা উল্টো! ভরসা নেই উন্নয়নে?

মমতা এখন কেজরীর মতোই চষে বেড়াচ্ছেন গোটা পশ্চিমবঙ্গ। সিএএ এবং এনআরসি-র বিরোধিতায় রাজ্য জুড়ে মিছিল-সভা করে বেড়াচ্ছেন তিনি।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২০ ১৯:০৬
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

‘‘আপকে স্কুল কা ইন্তেজাম কর দিয়া, আপকে পানি কা ইন্তেজাম কর দিয়া, আপকে দওয়া-দারু কা ইন্তেজাম কর দিয়া, আপকে...’’

Advertisement

এই পর্যন্ত বলেই থমকে গেলেন বক্তা। যে ছন্দে একটানা বলে যাচ্ছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে এসে, স্বর একটু নামিয়ে, ডান হাতটা উপরে তুলে বললেন, ‘‘দারুকা নহি, দওয়াকা।’’

হো হো করে হেসে উঠল মঞ্চের সামনের জমায়েতটা। বক্তাও হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘উধর এক আদমি খুশ হো গয়া থা বড়া (ওখানে এক জন খুব খুশি হয়ে উঠেছিলেন দেখলাম)।’’

Advertisement

বক্তার নাম অরবিন্দ কেজরীওয়াল, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ভাষণের এই ছোট্ট ক্লিপিং হু হু করে ছড়িয়েছে গোটা দেশে। হইচই চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিরোধীরা কটাক্ষ করছেন। বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গিতে প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘এক জন মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ এই রকম হতে পারে!’’ কিন্তু অনেকেই সে প্রশ্নে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না, নির্মল আনন্দ হিসেবেই নিচ্ছেন ব্যাপারটাকে। আর সমর্থকেরা বলছেন— এটাই অরবিন্দ কেজরীওয়াল, আম আদমির মুখ্যমন্ত্রী।

আসলে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ময়দানে নিজেকে শুধুমাত্র আম আদমির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। বিরাট মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা জাতীয় রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুখ বা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জার— এ রকম কোনও ভাবমূর্তিই তৈরি করতে আগ্রহী নন কেজরী। সচেতন ভাবেই আগ্রহী নন। তাই দিল্লির সরকারি স্কুলগুলোর উন্নয়ন তিনি কী ভাবে ঘটিয়েছেন, দিল্লির কোন কোন অংশে তিনি পানীয় জলের সঙ্কট মিটিয়েছেন, পাড়ায় পাড়ায় ‘মহল্লা ক্লিনিক’ খুলে দিয়ে কত লক্ষ দিল্লিবাসীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছেন— পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে এ সব নিয়েই কথা বলছেন কেজরীওয়াল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রিত্বের লড়াই, নাকি দিল্লির মেয়র হওয়ার লড়াই? কেজরীওয়ালের ভাষণ শুনলে ধন্দ জাগতে পারে।

কেজরীওয়ালের দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার এখন তুঙ্গে, অতএব তাঁকে চষে বেড়াতে হচ্ছে গোটা এলাকা। মমতার রাজ্যে নির্বাচন আগামী বছর। কিন্তু মমতাও এখন কেজরীর মতোই চষে বেড়াচ্ছেন গোটা পশ্চিমবঙ্গ। সিএএ এবং এনআরসি-র বিরোধিতায় রাজ্য জুড়ে মিছিল-সভা করে বেড়াচ্ছেন তিনি। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ বলছে, এর মাধ্যমেই ২০২১-র প্রস্তুতি অনেকটা সেরে রাখছেন মমতা। এক দিকে বিজেপি বিরোধী সুর তুঙ্গে তুলে রাখছেন, অন্য দিকে নিজের গোটা দলকে লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে রেখে ভোটের অনেক আগে থেকেই হাওয়া নিজের পালে টেনে রাখার চেষ্টা করছেন— মত বিশ্লেষকদের।

পালে হাওয়া টানার বা ধরে রাখার প্রশ্নে কেজরীওয়াল এবং মমতার কৌশল কিন্তু পুরো উল্টো। গত পাঁচ বছরে তিনি কী কী করেছেন দিল্লিবাসীর জন্য— কেজরীওয়ালের ভাষণ শুধুমাত্র সে বিষয়েই সীমাবদ্ধ। তাঁর ভাষণে সিএএ-এনআরসি নেই, কর্মসংস্থানের অভাবের কথা নেই, অর্থনীতির বেহাল দশার কথা নেই। এমনকি দিল্লির বুকে ঘটে যাওয়া যে ঘটনা ঘিরে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে গেল, সেই জেএনইউ হামলা নিয়েও সুর চড়াচ্ছেন না কেজরীওয়াল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আপাতত এই ইস্যুগুলোর চারপাশেই ঘুরছে। বিজেপি, আরএসএস এবং নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করছেন মমতা। সিএএ, এনআরসি বা এনপিআর— কোনওটাই হতে দেবেন না বলে চ্যালেঞ্জও ছুড়ছেন প্রায় রোজ।

এর কারণ কী? দিল্লিতে কেজরীওয়ালের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে মমতার প্রধান প্রতিপক্ষও বিজেপি। গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি-কে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার প্রশ্নে গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখগুলোর মধ্যে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছেন, তেমনই অরবিন্দ কেজরীওয়ালও রয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন আসতেই কেজরীওয়াল বড় বড় ইস্যুর মাঠ ছেড়ে দিয়ে একেবারে স্থানীয় স্তরের ইস্যু নিয়ে খেলতে শুরু করলেন কেন?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, বিজেপির ঘরে মাঠে গিয়ে খেলতে চাইছেন না কেজরী। তিনি বিজেপি-কে নিজের মাঠে এনে ফেলতে চাইছেন। অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দর কথায়, ‘‘দিল্লিতে জোর গলায় সিএএ বা এনআরসির বিরোধিতা করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, সে কথা অরবিন্দ কেজরীওয়াল জানেন। ওই সব ইস্যু নিয়ে কেজরীওয়াল সরব হন, এটা বিজেপি-ও চায়। কারণ তা হলেই এমন আরও অনেক কথা ভোটের ময়দানে ভেসে উঠবে, যাতে হিন্দুত্বের হাওয়া চাঙ্গা হবে। কেজরীওয়াল সেটা জানেন বলেই, ওই সব প্রসঙ্গে যেতেই চাইছেন না। দিল্লির মানুষের জন্য তিনি কী কী করতে পেরেছেন, শুধু তা নিয়েই কথা বলছেন।’’

কিন্তু যে কথা অরবিন্দ কেজরীওয়ালের মতো অপেক্ষাকৃত আনকোরা রাজনীতিক বুঝে যাচ্ছেন, দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা বুঝছেন না? অধ্যাপক নন্দের মতে, ‘‘মমতাও বুঝছেন, কিন্তু ওঁর কিছু করার নেই।’’ কেন করার নেই? নন্দের ব্যাখ্যা, ‘‘কেজরীওয়াল গত পাঁচ বছরে কী কী করেছেন, তা নিয়ে তাঁর অনেক কথা বলার রয়েছে। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিয়েছেন, বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ওষুধ দিয়েছেন, ডিটিসি-র বাসে মহিলাদের জন্য নিখরচায় সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ দেশে তো এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি ভালই ভোট টানে। কেজরীওয়াল সেটা এত সুচারু ভাবে করেছেন যে, তিনি ওইগুলোয় ভর করেই ভোট উতরোতে চাইছেন।’’

তবে বিশ্লেষক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এই তত্ত্বের সঙ্গে অনেকটাই দ্বিমত পোষণ করছেন। তিনি বলছেন, ‘‘অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও তুলনা হয় না। কেজরীওয়াল একটা সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন এবং মাত্র সাত-আট বছর তিনি রাজনীতি করছেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ১৯৮৪ সালের সাংসদ। দীর্ঘ দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকেছেন। সাড়ে আট বছর পশ্চিমবঙ্গের মতো এত বড় একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন। তাঁর মতো রাজনীতিক কিছুতেই সিএএ-এনআরসির মতো ইস্যু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না।’’

দিল্লির সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের তুলনা চলে না বলে অধ্যাপক উদয়নের মত। তাঁর কথায়, ‘‘দিল্লি তো কোনও পূর্ণাঙ্গ রাজ্য নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যত রকমের ক্ষমতা রয়েছে, তার অধিকাংশই দিল্লির সরকারের নেই। সুতরাং সিএএ-এনআরসি কার্যকরী হতে দেব না— এই চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুড়তে পারেন। অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার ক্ষমতা নেই।’’

কিন্তু বিজেপি-কে এই চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারলেই কেল্লা ফতে, এমনটা ভাবার কি কোনও কারণ রয়েছে? সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে যত বেশি হইচই হবে, বিজেপি-ও হিন্দুত্বের হাওয়া ততই তীব্র করে তোলার সুযোগ পাবে— এই সম্ভাবনাও তো রয়েছে। তা হলে গত সাড়ে আট বছরের উন্নয়নমূলক কাজকর্মের উপরে আলোটা বেশি করে কেন ফেলতে চাইছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কেন বিজেপির মাঠে না খেলে বিজেপি-কে নিজের মাঠে এনে ফেলছেন না?

এই বিষয়ে দুই বিশ্লেষকের মত পুরোপুরি না মিললেও, খানিকটা মিলছে।

উদয়ন বলছেন, ‘‘২০১৯ সালের ভোটের প্রচারে অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি উন্নয়ন ইস্যুকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব জোর দিয়ে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, তা খুব একটা কাজে এল না। বাংলায় নতুন ধরনের রাজনীতি আমদানি করা বিজেপির দিকেই বহু মানুষ ঝুঁকে পড়লেন। অতএব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়ানোকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিজেপি যে খুব বিপজ্জনক, তার দিকে যে ঝুঁকে পড়া যায় না, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন।’’

আর অধ্যাপক নন্দের কথায়, ‘‘কেজরীওয়াল তাঁর বিভিন্ন প্রকল্পকে যে ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন, তাতে তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, ওই সব প্রকল্পের কথা তুলে ধরে ভোট চাওয়া যায়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের মডেল তো আর খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নেই। উন্নয়ন যত না হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি। অতএব উন্নয়নের কথা বলে ভোট চাওয়া এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে কঠিন।’’

মমতা এবং কেজরীওয়ালের পরিস্থিতির মধ্যে ফারাক যেমন রয়েছে, তেমন মিলও কিন্তু রয়েছে। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, মমতা বা কেজরীওয়াল, কারও হাতেই কোনও ‘মুষ্টিবদ্ধ ভোটব্যাঙ্ক’ নেই। উত্তরপ্রদেশে দলিতরা মায়াবতীর বা বিহারে যাদবরা অখিলেশের, বা হরিয়ানায় জাঠরা কংগ্রেসের বা রাজস্থানে রাজপুতরা বিজেপির— বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দলের এই রকম কিছু ‘মুষ্টিবদ্ধ ভোটব্যাঙ্ক’ রয়েছে। এই ভোটরার প্রায় কোনও পরিস্থিতিতেই আনুগত্য পরিবর্তন করেন না। কিন্তু কেজরীওয়াল বা মমতার এই রকম কোনও ভোটব্যাঙ্ক নেই। তাই যে ভোটব্যাঙ্ক সঙ্গে রয়েছে, তাঁরা যাতে অসন্তুষ্ট না হন বা তাঁদের যাতে খুশি রাখা যায়, এ কথা মমতা বা কেজরীদের সব সময়েই ভাবতে হয়। ঠিক সেই কারণেই মমতা এবং কেজরীওয়াল আপাতত উল্টো নীতি নিয়ে চলছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

অধ্যাপক নন্দর কথায়, ‘‘দিল্লিতে কেজরীওয়ালকে যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন, সিএএ বা এনআরসির ঘোর বিরোধিতা করলে তাঁদের অনেকে পাশ থেকে সরে যেতে পারেন। আর বাংলায় এই মুহূর্তে মমতার সবচেয়ে বড় ভরসা যে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক, তাঁদের ধরে রাখতে গেলে আবার সিএএ-এনআরসির তীব্র বিরোধিতাই করতে হবে। মমতা সেটাই করছেন।’’

শুধু সংখ্যালঘু ভোট অবশ্য নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে পশ্চিমবঙ্গে একটা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তৈরি করতে চাইছেন বলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত। তাঁরা বলছেন, সংখ্যালঘুদের একমাত্র মিত্র তিনি, এই বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি উদ্বাস্তু হয়ে আসা জনগোষ্ঠীর মনেও ভয় ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন মমতা। অসমের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি দাবি করছেন, বিজেপি যা করছে, তাতে উদ্বাস্তুদের বিপদ হবে। এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং যদি সফল হয়, যদি সংখ্যালঘুদের সমর্থন প্রায় পুরোটাই পাওয়ার পাশাপাশি উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর একটা অংশকেও মমতা পাশে পেয়ে যান, তা হলে ২০২১ উতরে যেতে তাঁর কোনও সমস্যা হবে না— মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement