নোট বাতিলে বৃদ্ধির হার নেমে আসতে পারে ৬.৫ শতাংশে, কবুল কেন্দ্রের

আশঙ্কাই সত্যি হল। নোট বাতিলের ধাক্কায় অর্থনীতির কাজকারবার যে কমে এসেছে, সব ক্ষেত্রেই তা চোখে পড়ছিল। আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, এর ফলে বৃদ্ধির হার কমে আসবে। আজ সরকারি আর্থিক সমীক্ষা সে কথাই জানিয়ে দিল। আর্থিক সমীক্ষার পূর্বাভাস, চলতি বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। গত অর্থ বছরে যা ছিল ৭.৬ শতাংশ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২১
Share:

আশঙ্কাই সত্যি হল।

Advertisement

নোট বাতিলের ধাক্কায় অর্থনীতির কাজকারবার যে কমে এসেছে, সব ক্ষেত্রেই তা চোখে পড়ছিল। আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, এর ফলে বৃদ্ধির হার কমে আসবে। আজ সরকারি আর্থিক সমীক্ষা সে কথাই জানিয়ে দিল। আর্থিক সমীক্ষার পূর্বাভাস, চলতি বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। গত অর্থ বছরে যা ছিল ৭.৬ শতাংশ।

মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণিয়নের অবশ্য দাবি, আগামী অর্থ বছর, অর্থাৎ ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ২০১৭-’১৮-য় অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে। তখন বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭.২৫ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু নোট বাতিলের কালো ছায়া যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, তার জন্যও বেশ কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছেন সুব্রহ্মণিয়ন। তাঁর যুক্তি, নোট বাতিলের ফলে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। কারণ কর্পোরেট সংস্থা বা গৃহস্থ কেউই এর প্রভাব বা ফলাফল নিয়ে নিশ্চিত নন। ফলে গৃহস্থর ভোগ্যপণ্য কেনা বা শিল্প সংস্থার লগ্নি থমকে রয়েছে। এই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অর্থনীতির উপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে যত দ্রুত সম্ভব নতুন নোটের জোগান বাড়াতে হবে এবং যত নোট তুলে নেওয়া হয়েছে, তার পুরোটাই আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। তার সঙ্গে কর আদায়ের ক্ষেত্রে মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত এবং আয়কর দফতরের হেনস্থা বন্ধ করলেও লগ্নিকারীদের আস্থা ফিরতে পারে।

Advertisement

তা হলে প্রশ্ন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যদি বাতিল নোটের সমান অর্থই নতুন নোটে ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে এত দিন মোদী-জেটলি যে কম নগদের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন, তার কী হবে?

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি-র অর্থনীতিবিদ পিনাকী চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘প্রশ্নটা সমীচিন। কিন্তু নোট বাতিল করে আবার নতুন নোট ফিরিয়ে আনলেই অর্থনীতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে এমন আশা করলে বলতে হয়, কাউকে ওপেন হার্ট সার্জারি থেকে উঠিয়েই ম্যারাথন দৌড়তে বলা হচ্ছে। তা সম্ভব নয়। এমনিতেই বিশ্বে রক্ষণশীল মনোভাব, তেলের দাম বৃদ্ধি, জিএসটি চালুর দিনক্ষণ নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী বছরের পূর্বাভাস নিয়েও সংশয় থাকছে।’’ সুব্রহ্মণিয়নের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, এই সব আশঙ্কা রয়েছে বলেই তিনি নির্দিষ্ট একটি হারের পূর্বাভাস করেননি।

নোট বাতিল নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম মন্তব্য করেছিলেন, নোট বাতিলের আগে সুব্রহ্মণিয়নের সঙ্গে আলোচনাই হয়নি। আজ সুব্রহ্মণিয়ন বলেন, ‘‘কথায় বলে, নীরবতার থেকে কিছু ভাল বলার থাকলে তবেই মুখ খোলা উচিত। আমি বলি, হট্টগোলের থেকে ভাল কিছু থাকলেই মুখ খুলতে হয়।’’ নোট বাতিলের কুপ্রভাব নিয়ে অবশ্য নীরব থাকেননি তিনি। তাঁর বক্তব্য, নোট বাতিলের ফলে লগ্নি, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ ও কর্মসংস্থান কমেছে। কারণ বাজারে নগদের জোগান কমে যাওয়ায় কেনাকাটা কমেছে। চাষআবাদ থেকে কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে জোগানও কমেছে। আবাসনের দাম পড়েছে, মার খেয়েছে বিক্রি। সব থেকে বেশি মার খেয়েছে অটোমোবাইল ক্ষেত্র, বিশেষ করে বাইক-স্কুটারের বিক্রি। এই সব কিছুর জেরেই বৃদ্ধির হার মার খাবে।

তা হলে লাভ কী হল?

নোট বাতিল করে মোদী ঘোষণা করেছিলেন, এর ফলে কালো টাকা, জাল নোট, দুর্নীতি দূর হবে। ডিজিটাল লেনদেন বাড়বে। আর্থিক সমীক্ষায় সুব্রহ্মণিয়ন বলেছেন, পুরনো নোটে জমা পড়া টাকা ব্যাঙ্কে থিতু হলে সুদের হার কমতে পারে। দুর্নীতি বা বেআইনি কাজকারবার কমতে পারে— যদি আইন মেনে চলায় কিছু উৎসাহ দেওয়া হয়। ডিজিটাল লেনদেনের বিপ্লব চলবে। তবে নগদের জোগান স্বাভাবিক হলে অনেকেই আবার নগদ লেনদেনে ফিরে যাবেন। জেটলি দাবি করেছিলেন, নোট বাতিলের পরেও কর আদায় বেড়েছে। সুব্রহ্মণিয়ন বলছেন, এর সঙ্গে নোট বাতিলের সম্পর্ক নেই। বৃদ্ধির হার কমলে পরোক্ষ কর বা কর্পোরেট কর বাবদ আয়ও কমবে। একমাত্র দীর্ঘমেয়াদে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লেনদেন বাড়লে কর আদায় বাড়তে পারে। একমাত্র নিশ্চিত বিষয় হল, ব্যাঙ্কে সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়বে।

প্রশ্ন উঠেছে, এইটুকু লাভের জন্য নোট বাতিলের যন্ত্রণার মধ্যে গিয়ে পড়াটা কি সত্যিই দরকার ছিল? সুব্রহ্মণিয়ন এর জবাব দিতে চাননি। তাঁর যুক্তি, অতীত ঘাঁটার ইচ্ছে তাঁর নেই। ইতিহাসই এর বিচার করুক। নোট বাতিলের পরিকল্পনা ও রূপায়ণ ঠিক মতো করা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও তিনি মুখ খুলবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন সুব্রহ্মণিয়ন।

কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মার কটাক্ষ, ‘‘ইচ্ছে করেই মুখ খোলেননি মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। কারণ মুখ খুললে তাঁকে সরকারের নিন্দাই করতে হতো। মোদী সরকার যে ভাবে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার পিছনে না ছিল কোনও পরিকল্পনা, না সঠিক ভাবে তার রূপায়ণ হয়েছে।

কিছু দিন আগে কেন্দ্রের পরিসংখ্যান মন্ত্রক বলেছে, চলতি অর্থ বছর, অর্থাৎ ২০১৫-’১৬-য় বৃদ্ধির হার ৭.১ শতাংশে নেমে আসতে পারে। কিন্তু নোট বাতিলের ধাক্কা সেই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়নি। আজ সুব্রহ্মণিয়ন জানিয়েছেন, তিনি ৭ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা ০.২৫ শতাংশ থেকে ০.৫ শতাংশ কম হতে পারে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ)-ও ভবিষ্যৎবাণী করেছে, নোট বাতিলের ফলে বৃদ্ধির হার ৬.৬ শতাংশে নেমে আসবে।

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে জেটলি বাজেটে ঘাটতি বাড়িয়ে বাড়তি খরচের পথ নিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। আর্থিক সমীক্ষায় অবশ্য সতর্ক করা হয়েছে, উন্নত অর্থনীতির মতো বাড়তি খরচ করতে গিয়ে ঋণের বোঝা কমানোকে গুরুত্ব না দেওয়া ভারতের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। সুব্রহ্মণিয়নের যুক্তি, যখন অর্থনীতির বহর বাড়ছে, তখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে খরচ করা উচিত নয়। আবার মন্দার সময়ও হাল ফেরাতে এমন খরচ করা উচিত নয়, যাতে ঋণ ও সুদের বোঝা লাগামছাড়া হয়ে যায়।

অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে আর্থিক সমীক্ষায় দাওয়াই দেওয়া হয়েছে, ব্যাঙ্ক-এটিএম থেকে টাকা তোলার ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিতে হবে। ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে হবে, কিন্তু জোর করে বা নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে নয়, উৎসাহ ভাতা দিয়ে। আবাসন ও জমির লেনদেনকে জিএসটি-র আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কর ও স্ট্যাম্প ডিউটির হার কমাতে হবে। তৈরি করতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ কর প্রশাসন। আর্থিক সমীক্ষার মতে, এখনও ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ বা অনুৎপাদক সম্পদ বড় মাথা ব্যথার কারণ। এক দিকে বড় শিল্প সংস্থা, অন্য দিকে ব্যাঙ্ক, দুইয়ের খাতাতেই অনাদায়ী ঋণ জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে। এর সমাধানে একটি ‘পাবলিক সেক্টর অ্যাসেট রিহ্যাবিলিটেশন এজেন্সি’ তৈরির সুপারিশ করেছেন সুব্রহ্মণিয়ন। যার কাজই হবে সরকারের হয়ে এই সমস্যার সমাধান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement