যন্তর-মন্তরের মঞ্চ থেকে কংগ্রেসকে কঠিন বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।— ছবি পিটিআই।
সকাল থেকে মেজাজ তাঁর ফুরফুরেই ছিল। সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাংলো থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেরিয়ে পড়েছিলেন পৌনে ১২টা নাগাদ। সোজা সংসদ। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা তাঁর কানে পৌঁছল, তাতে আচমকা আবহাওয়া গুমোট। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাসটা সনিয়া গাঁধী পেলেন সংসদের সেন্ট্রাল হলে দাঁড়িয়েই। স্বভাবসিদ্ধ সংযমে সনিয়া পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টাও করলেন। কিন্তু পুরোটা পারলেন না। যন্তরমন্তরের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার যে বার্তা দিলেন, তা রাহুল গাঁধীর পক্ষে মোটেই স্বস্তির হল না।
কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর নিজের দলের সম্পর্ক এবং কংগ্রেসের সঙ্গে বৃহত্তর বিরোধী জোটের সমঝোতা— এই দুই প্রসঙ্গেই এ দিন যন্তরমন্তরের ‘সত্যাগ্রহ’ মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ খুলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতার কথাই যে আর ভাবছেন না তিনি, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘‘কংগ্রেস-বিজেপি-সিপিএমের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে,’’—পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এ দিন অরবিন্দ কেজরীবালের মঞ্চ থেকে এই রকম মন্তব্যই করেছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী বৃহত্তর জোটের অন্যতম সংগঠক যিনি, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিজের রাজ্যে কংগ্রেস বা বামেদের ভূমিকা নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন, রাজধানীর হাটে সেই হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে সে কথা স্পষ্ট করে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটুও দ্বিধা করেননি এ দিন। কংগ্রেস এবং বামেরা দিল্লিতে যা-ই বলুক, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বিজেপি বিরোধী ভূমিকা যে একেবারেই সন্তোষজনক নয়, বিরোধী দলগুলির জাতীয় নেতৃত্বের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন তা স্পষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি কারও সঙ্গে সমঝোতার কথা যে ভাবছেন না, সে কথাও বুঝিয়ে দেন। সমঝোতা করলেও কংগ্রেস বা বামেরা পশ্চিমবঙ্গে তাদের ভোট তৃণমূলকে ‘ট্রান্সফার’ করবে না— বেশ খোলাখুলিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন এই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: মনে রাখব আমরা, ক্ষোভ সামলাতে না পেরে সনিয়াকে বললেন মমতা
কংগ্রেসের সঙ্গে সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক বেশ ভাল যাচ্ছিল বা কংগ্রেসকে নেতৃত্বে রেখেই তিনি বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার কথা ভাবছিলেন বা রাহুল গাঁধীকে বিরোধী শিবিরের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরায় তাঁর সায় ছিল— এমনটা মোটেই নয়। কংগ্রেসকে বাদ রেখে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলাই বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিচ্ছিলেন জোট প্রচেষ্টার সূচনা লগ্ন থেকেই। আর পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক যে আরও গোলমেলে, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু রাজধানীর বুকে আয়োজিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতীয় স্তরের এক সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন যে ভাবে নিজের চিরশত্রু বাম এবং সাম্প্রতিক কালের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির সঙ্গে প্রায় একাসনে বসিয়ে দিলেন কংগ্রেসকে, তা রাহুল গাঁধীর পক্ষে সুখকর হওয়ার কথা নয়।
আরও পড়ুন: শিলং থেকে শহরে পৌঁছলেন রাজীব কুমার, আদালতে নিরাপত্তা চাইলেন কুণাল
কংগ্রেসের জন্য অস্বস্তির কারণ আরও রয়েছে। বিরোধী দলগুলির মধ্যে সর্বভারতীয় স্তরে সমঝোতার রূপরেখাটা কেমন হবে, তা নিয়েও এ দিন নিজের মতামত জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যন্ত্ররমন্তরের মঞ্চ থেকে তাঁর সাফ কথা— যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী, সেই রাজ্যে বিজেপি বিরোধী ময়দান সেই দলকেই ছেড়ে দিতে হবে। বাংলায় যদি তৃণমূল শক্তিশালী হয়, তা হলে সেখানে তৃণমূলই লড়বে, অন্ধ্রপ্রদেশে যদি চন্দ্রবাবু নায়ডু শক্তিশালী হন, তা হলে সেখানে চন্দ্রবাবু নায়ডুই লড়বেন— মন্তব্য মমতার। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি বিরোধী জোট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু অখিলেশ এবং মায়াবতীকেই গুরুত্ব দিলেন। সে জোটে অজিত সিংহের দলকেও সামিল করে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের নামটাও উচ্চারণ করলেন না। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান বা ছত্তীসগঢ়ের মতো যে সব রাজ্যে কংগ্রেসের প্রায় একক সরকার রয়েছে, সেই সব রাজ্যে কংগ্রেস লড়ুক— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া ‘জোট ফর্মুলা’ এই রকমই।
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী নিজেও জানেন যে, পশ্চিমবঙ্গে তাঁর দলের অবস্থা ভাল নয়। তাই সে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোষে কংগ্রেসের আর নতুন করে ক্ষতি হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে ভাল ফল করতে রাহুল মরিয়া। প্রিয়ঙ্কা গাঁধীকে তুরুপের তাসের মতো রাহুল সামনে এনেছেন উত্তরপ্রদেশে। সেই রাজ্যের বিজেপি বিরোধী লড়াই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামই উচ্চারণ করছেন না কংগ্রেসের, এটা রাহুলের পক্ষে মেনে নেওয়া একটু কঠিন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন— পশ্চিমবঙ্গে ৪২টা আসনের সব ক’টা তিনি জিতবেন। আর দিল্লির শাসক দল তথা এ দিনের সমাবেশের আয়োজক আম আদমি পার্টিকে (আপ) সভামঞ্চ থেকে তিনি বার্তা দিয়েছেন— দিল্লির ৭টি লোকসভা আসনের ৭টিই আপকে জিততে হবে, একটা আসনও যেন অন্য কেউ না পায়। বিজেপি আাসন না পাক— এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাভাবিক ভাবেই চাইবেন। কিন্তু দিল্লিতে আপ ছাড়া আর কেউ কোনও আসন যেন না পায়— এই মন্তব্যে যে কংগ্রেসের জন্যও বার্তা রয়েছে, তা খুব স্পষ্ট ভাবে বোঝা গিয়েছে।
বুধবারই ছিল সংসদে অধিবেশনের শেষ দিন। মোদী সরকারের মেয়াদে আর সংসদ বসবে না। সে কথা মাথায় রেখেই এ দিন অন্যান্য কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আগে সংসদের সেন্ট্রাল হলে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিএসপি-র সতীশ মিশ্র, এসপি-র ধর্মেন্দ্র যাদব-সহ বিরোধী শিবিরের বেশ কয়েক জন নেতার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সে সব আলোচনা বেশ ইতিবাচকই ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে এ দিন সংসদে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীর বক্তব্য তৃণমূলের পক্ষে মোটেই সুখকর ছিল না। সারদা-রোজভ্যালি-সহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে অধীর চৌধুরী এ দিন অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আঙুল তোলেন তৃণমূলের দিকে। বিজেপি সাংসদরা উচ্ছ্বসিত ভাবে সমর্থন জানান অধীরকে। সংসদে পৌঁছে সে খবর পাওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে আর ঠান্ডা থাকা সম্ভব হয়নি। সনিয়া গাঁধীকে সামনে পেয়েই তিনি নিজের বিরক্তি ও অসন্তোষ স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। লোকসভায় কংগ্রেসের এই ভূমিকা যে তিনি ‘মনে রাখবেন’, তা-ও সনিয়াকে সর্বসমক্ষেই বলেন তিনি।
ইস্যুভিত্তিক ফারাক থাকলেও কংগ্রেস এবং তৃণমূল কিন্তু পরস্পরের মিত্র— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ দিন সনিয়া এই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে যন্তরমন্তরে ভাষণ দেওয়ার সময়ে সাংসদ তথা কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক আনন্দ শর্মা আর এক দফা চেষ্টা করেন মমতাকে প্রশমিত করার। কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুবিশাল সমাবেশ করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি ৩৫-৪০ বছর ধরে চেনেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার বোনের মতো— এমন নানা কথা বলতে শোনা যায় আনন্দ শর্মাকে। কিন্তু তাতে লাভ যে হয়নি, সে কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এ দিন।
রাহুল গাঁধীকে বিরোধী জোটের নেতা হিসেবে যে তিনি দেখতে চান না— সে ইঙ্গিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেও একাধিক বার দিয়েছেন। রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মেনে নিয়ে জোটে যাওয়ার প্রশ্নই নেই, প্রয়োজনে কংগ্রেসকে বাদ রেখেই জোট হোক— এই বার্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই দিয়ে আসছেন। যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল বা রাজ্য দল শক্তিশালী, সেই রাজ্যে সেই দলকেই বিজেপি বিরোধিতার মুখ হিসেবে মেনে নিতে হবে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই তত্ত্বও নতুন নয়। কিন্তু বৃহত্তর বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে এই সব প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু দিন চুপ ছিলেন। কিন্তু সিবিআই-কলকাতা পুলিশ টানাপড়েন পর্বে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের অবস্থানের কারণে হোক বা বুধবার সংসদে অধীর চৌধুরীর ভাষণের কারণে— মমতা ফের বেজায় অসন্তুষ্ট কংগ্রেসের উপরে। সে অসন্তোষ তিনি গোপন করার চেষ্টাও করলেন না। কংগ্রেসের প্রতিনিধিকে গোটাটা হজমও করতে হল যন্তরমন্তরের মঞ্চে বসে।