নর্দমার পাশে শিল্পীর বাক্সবন্দি দেহ উদ্ধার মুম্বইয়ে

অর্ধনগ্ন দু’টি দেহ। হাত-পা বাঁধা। বড় প্লাস্টিকে মুড়ে তার পর সেগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্সে পুরে কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিল নর্দমার পাশে। উদ্ধার করার এক দিন পরে পুলিশ জানিয়েছে, দেহ দু’টি তরুণ খ্যতনামা শিল্পী হেমা উপাধ্যায় (৪৩) এবং তাঁর আইনজীবী হরিশ ভামভানির (৬৫)।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

মুম্বই শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:০১
Share:

অর্ধনগ্ন দু’টি দেহ। হাত-পা বাঁধা। বড় প্লাস্টিকে মুড়ে তার পর সেগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্সে পুরে কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিল নর্দমার পাশে। উদ্ধার করার এক দিন পরে পুলিশ জানিয়েছে, দেহ দু’টি তরুণ খ্যতনামা শিল্পী হেমা উপাধ্যায় (৪৩) এবং তাঁর আইনজীবী হরিশ ভামভানির (৬৫)।

Advertisement

শনিবার সন্ধেবেলা মুম্বই শহরতলির কান্দিভলি এলাকায় উদ্ধার হয় দেহ দু’টি। দেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে আজ। কে বা কারা ওই বাক্সে ভরে দেহ দু’টি ওই ভাবে ফেলে রেখে গিয়েছিল, তা নিয়ে এখনও ধন্দে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, তাঁদের গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। শরীরের বাইরে আর কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার পর থেকে হেমা-হরিশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ।

রহস্য-মৃত্যুর তালিকায় হেমা-হরিশ সাম্প্রতিকতম সংযোজন। আরুষি তলোয়ার, অভিনেত্রী জিয়া খান বা লায়লা খান এবং অতি সম্প্রতি শিনা বরা— খুনের এই সব হাই প্রোফাইল মামলাই উঠে এসেছে সংবাদ শিরোনামে। জনমানসে কম চাঞ্চল্য তৈরি হয়নি এই মামলাগুলি ঘিরে। হেমার মতো শিল্পী এবং আইনজীবী হরিশের দেহ যে অবস্থায় নর্দমার পাশ থেকে উদ্ধার হয়েছে, তার পিছনেও বড়সড় ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, প্রশ্ন উঠছে সব মহলেই।

Advertisement

পুলিশ সূত্রে খবর, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় প্রায় অর্ধনগ্ন দেহ দু’টি প্যাকেটে মুড়ে সেলাই করে দিয়ে ভরা হয়েছিল বাক্সে। উদ্ধারের পরে দেখা যায় হরিশের মুখও বাঁধা। দেহ দু’টি দেখে পুলিশের মনে হয়েছে, সে ভাবে পচন ধরেনি। যা থেকে তাদের অনুমান, মাত্র দু’দিন আগেই হয়তো খুন করা হয়েছিল ওই শিল্পী এবং তাঁর আইনজীবীকে।

অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আপাতত খুনের মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। দেহ দু’টি পাঠানো হয়েছে ময়না-তদন্তে। মুম্বই পুলিশের অপরাধদমন শাখা এই ঘটনার তদন্ত করছে। এখনও কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। হেমা এবং হরিশের পরিচিত লোকজনকে আপাতত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একটি সূত্রে দাবি, হেমার বিচ্ছিন্ন স্বামী চিন্তন উপাধ্যায় এবং তাঁর পরিচারককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মুম্বই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বিক্রম দেশপাণ্ডে বলেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ঘটনাক্রম দেখে এটা খুন বলেই মনে হচ্ছে। তবে কী ভাবে খুন, ময়না-তদন্তের পরে কিছুটা বোঝা যাবে।’’

শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার পরে হেমা-হরিশের টেলি-কথোপকথনের আর কোনও রেকর্ড নেই বলে জানাচ্ছে পুলিশ। শনিবার সন্ধ্যায় দেহগুলি যখন উদ্ধার হয়, তার আশপাশে শনাক্তকরণের মতো কিছুই ছিল না। মোবাইল, মানিব্যাগ বা গয়নাগাঁটি কিছু মেলেনি দেহের সঙ্গে। তাই পুলিশের দেহ শনাক্ত করতে রবিবার সকাল হয়ে যায়।

হেমা জন্মসূত্রে বডোদরার বাসিন্দা। সেখানকার এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পকলায় স্নাতক হন। ছাত্রজীবনেই আলাপ হয় চিন্তন উপাধ্যায়ের সঙ্গে, যিনি পরে শিল্পী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। ২০১০ সালে বিচ্ছেদের মামলা করেন দু’জনে। চিন্তন মুম্বই ছেড়ে দিল্লি চলে যান। তারও তিন বছর পরে ২০১৩ সালে চিন্তনের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ করেন হেমা। তাঁর অভিযোগ ছিল, মুম্বইয়ে তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টে ঘরের দেওয়ালে অশালীন ছবি এঁকেছিলেন চিন্তন। বিবাহবিচ্ছেদ ও হেনস্থার অভিযোগের মামলা— দু’টোতেই হেমার আইনজীবী ছিলেন হরিশ।

তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, সম্পত্তি নিয়ে গোলমালের জেরে স্বামীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন হেমা। চলছিল বিচ্ছেদের মামলাও। আদালতে এই সব মামলাতেই হেমার হয়ে সওয়াল করছিলেন আইনজীবী হরিশ ভামভানি। স্বাভাবিক ভাবে পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ এখন চিন্তনের দিকেই। তিনি এখন দিল্লিতে থাকেন। রবিবারই তাঁকে মুম্বই ডেকে এনে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে পুলিশ।

গত শুক্রবার গভীর রাতেও জুহুর বাড়িতে না ফেরায় হেমার পরিচারক হেমন্ত মণ্ডল মালকিনকে বেশ কয়েক বার ফোন করেন। কিন্তু সাড়া মেলেনি। তার পর রাত একটা নাগাদ সান্তা ক্রুজ থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন তিনি। হেমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এমনকী চিন্তনকেও হেমার নিখোঁজ হওয়ার খবর দেন।

হেমন্তের দাবি, সে দিন বাড়ি থেকে সকাল-সকাল বেরিয়ে হেমা সোজা চলে যান আন্ধেরির বীর দেশাই রোডের কাছে নিজের স্টুডিও ‘লক্ষ্মী ইন্ডাস্ট্রিজ’-এ। তার পরে সে দিন সন্ধেবেলা মালকিনের গলা ফোনে শেষ বার শুনেছিলেন হেমন্ত। তাঁর কথায়, ‘‘শুক্রবার সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ উনি ফোন করেন। আমায় রাতে খেয়ে নিতে বলেন। উনি বাইরে খেয়ে ফিরবেন বলেছিলেন।’’ ওই স্টুডিওর সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে পুলিশের হাতে। যাতে দেখা যাচ্ছে, শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ একটি হন্ডা সিটি গাড়িতে হেমা তাঁর আইনজীবী হরিশের সঙ্গে স্টুডিও চত্বর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সেই গাড়িটির তার পর থেকে খোঁজ নেই বলে পুলিশের দাবি।

শুক্রবার বাড়ি না ফেরায় মাতুঙ্গা থানায় শনিবার দুপুরে অভিযোগ জানিয়েছিলেন হরিশ ভামভানির পরিবারও। পুলিশ বলছে, শুক্রবার সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ মাতুঙ্গায় কিঙ্গ সার্কেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান হরিশ। বলে যান, আন্ধেরিতে এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। তার পর আর ফেরেননি বলে দাবি পরিবারের।

এই ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ যেমন চিন্তনের দিকে, হেমার বন্ধুরাও কিছুটা তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। কেউ অবশ্য এটা বলছেন না, যে চিন্তন খুন করতে পারেন। তবে হেমার পাশে চিন্তন একেবারেই অন্য ধরনের মানুষ বলে মনে করছেন তাঁরা। বডোদরার এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগের দুই ছাত্রছাত্রী হেমা-চিন্তনকে সেই সময় থেকেই চিনতেন বৈভব বিশাল নামে তাঁদের এক বন্ধু। বৈভবের কথায়, ‘‘মৃদুভাষী, সদাহাস্যময় হেমাকে সকলেই পছন্দ করত। ওঁর শিল্পকর্মও প্রশংসনীয় ছিল।’’ কিন্তু হেমার সঙ্গে চিন্তনের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কারণ চিন্তন একেবারেই বিপরীত প্রকৃতির বলে মনে করতেন সবাই। শেষমেশ ওঁদের বিয়ে হয় বলে জানাচ্ছেন বন্ধুরা।

কিন্তু হেমা-চিন্তনের সম্পর্কে কবে থেকে ভাঙনের শুরু, জানেন না ওই বন্ধু। শিল্পী হিসেবে হেমার পৃথক সত্তা তৈরি হওয়ার পরে স্বামী হিসেবে চিন্তন নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন মনে হয়েছে বন্ধুদের। ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্কটের জেরে থেমে যায়নি হেমার শিল্পী-সত্তা, দাবি পরিচিতদের। সেটাই কি মানতে পারেননি চিন্তন? তবে সেই তিক্ততার ফলে হেমার এই পরিণতি হবে, ভাবেননি কেউই। কে বা কারা শেষ করে দিল সম্ভাবনাময় এই শিল্পীর জীবন? এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর স্বজন ও বন্ধুদের মনে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement