প্রবল বৃষ্টি শুরু নীলাচলে। নিজস্ব চিত্র।
পূর্বাভাসের থেকে ৫-৬ ঘণ্টা আগেই স্থলভাগে আছড়ে পড়ার কথা ছিল ফণীর। সেই মতোই শুক্রবার সকালেই ২০০ কিমি বেগে ওড়িশায় আছড়ে পড়ল ফণী।
গত তিন দিন উপগ্রহ চিত্রে গতিবিধির ওপর নজর রাখার পরে হাওয়া অফিস জানিয়েছিল, শুক্রবার বেলা তিনটের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে স্থলভূমিতে ঢুকবে সাইক্লোন ফণী। কিন্তু তার আগেই সকাল ৮.৫০ নাগাদ ওড়িশায় ঢুকে পড়ল ফণী।
এখন সেই পূর্বাভাস বদলে দিল্লির মৌসম ভবনের সাইক্লোন সতর্কতা কেন্দ্রের প্রধান মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানাচ্ছেন, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ১২টার মধ্যে কোনও এক সময়ে ফণী আছড়ে পড়বে পুরী সংলগ্ন গোপালপুরে (গঞ্জামের ‘গোপালপুর অন সি’ নয়)। এর পরে তটরেখা ধরে সেটি পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে দক্ষিণবঙ্গের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে যেতে পারে।
আপাতত ফণীর মারের মোকাবিলায় সাজো সাজো রব ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে। জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার-এর হিসেব অনুযায়ী গত ২০ বছরে এই অঞ্চলের সব চেয়ে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড়ে পরিণত হয়েছে ফণী। এর আগে ১৯৯৯-এ এই মাত্রায় পৌঁছনো সুপার সাইক্লোনে প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বিপুল।
বিপদসঙ্কেত: পুঁতে দেওয়া হয়েছে লাল পতাকা। ঢেউ দেখতে পুরীতে তখনও ভিড়। বৃহস্পতিবার। এএফপি
কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে আজ বিকালে দিল্লিতে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৈঠকে ছিলেন ক্যাবিনেট সচিব পি কে সিন্হা ও পিএমও-র পদস্থ আমলারা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব গৌবা। এ ছাড়া ছিলেন মৌসম ভবন ও এনডিআরএফের শীর্ষ কর্তারা।
নিউটাউনের সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কাল আরও একটা ঝড়ঝঞ্ঝার পূর্বাভাস আছে। উপকূল এলাকা, দুই মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়ার মতো ৭-৮টি জেলায় সবাইকে ২৪ ঘণ্টা সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’’ বৃহস্পতিবার মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতর বৈঠক করে আগাম প্রস্তুতির রূপরেখা তৈরি করছে। সব জেলাকে সেই নির্দেশ দিয়েও দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কলকাতা বিমানবন্দরে সব বিমান ওঠানামা বন্ধ রাখা হচ্ছে। ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর বৃহস্পতিবার রাত ১টা থেকে বন্ধ থাকছে ২৪ ঘণ্টা।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
প্রশাসনিক কর্তাদের অনুমান, ফণী দিঘা উপকূল দিয়ে ঢুকে পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনা হয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে যাবে। কিন্তু প্রভাব পড়বে এই গতিপথের দু’ধারের বিস্তীর্ণ এলাকায়। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির উপকূল এবং নিচু এলাকাগুলি থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পানীয় জল, বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার পাশপাশি এবং গাছ-বাড়ি ভেঙে পড়লে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো বাহিনী জেলায় জেলায় তৈরি রাখা হচ্ছে।
বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে দিঘা, বকখালি, মন্দারমণি ও সুন্দরবন এলাকায়। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর জলের পাউচ তৈরি করে রেখেছে। নবান্নে ১০০ জনের কুইক রেসপন্স টিম মজুত রাখা হচ্ছে।
সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের ছুটি বাতিল করে বিভিন্ন বাঁধে নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি টেলিফোন সংস্থাগুলির মাধ্যমে উপকূল এলাকায় এসএমএস এলার্ট দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ৪৫৪টি সাইক্লোন সেন্টারে উপকূল এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের রাখা হবে। ৬ মে যে সমস্ত এলাকায় নির্বাচন রয়েছে, সেখানে ব্যালট বাক্স এবং ভোটকর্মীদের ঠিক মতো পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে প্রশাসনকে।
কলকাতায় সব বিজ্ঞাপন হোর্ডিং খুলে দিতে পুরসভাকে নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য। লালবাজারে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলাগুলিতে জেলাশাসকেরা কন্ট্রোল রুম সক্রিয় রাখবেন। রাজ্যের সিদ্ধান্ত, শনিবার বিকেল পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হবে। কলকাতা ছাড়াও হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে ফেরি পরিষেবা নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দিঘা ও মন্দারমণি সৈকতে মাইক প্রচার করে সকলকে সতর্ক করা হচ্ছে। দিঘা থেকে পর্যটকদের ফেরাতে ভোর পাঁচটা থেকে আধঘণ্টা অন্তর বাস চালাবে পরিবহণ দফতর। কৃষি দফতরের পরামর্শ মেনে পূর্ব মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও দুই ২৪ পরগনায় বহু চাষি আগাম ধান কেটে সরিয়ে ফেলেছেন।
নতুন নির্দেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য দফতরের সব কর্মীর ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত জেলার র্যাপিড রেসপন্স টিম-কে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে এমন এলাকায় প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ, জেলা, মহকুমা এবং ব্লক স্তরের হাসপাতালে চিকিৎসকদের দল বিপর্যয় পরবর্তী পরিস্থিতির মোকাবিলায় তৈরি থাকবে। আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও প্রস্তুত থাকবেন। স্বাস্থ্যভবনে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বিদ্যুৎ ভবনের কন্ট্রোল রুমে অতিরিক্ত কর্মী রাখার পাশাপাশি জেলার অফিসগুলিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত ছুটিও বাতিল হয়েছে কর্মীদের।
বিশেষ সতর্কতা নিয়েছে রেলও। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দুটি জোনেই বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে এ দিন জরুরি বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট জেনারেল ম্যানেজার। ঝড়ের প্রভাব সব চেয়ে বেশি পড়ার আশঙ্কা দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এলাকায়। শুক্রবার থেকেই ওই রেলের আওতায় সমস্ত সেতু, বাঁধ ও রেললাইনে বিশেষ নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঝড় সরে না যাওয়া পর্যন্ত ওই নজরদারি চলবে। আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পাথরের গুঁড়ো ভর্তি ওয়াগন, গাছ কাটার যন্ত্র, বালির বস্তা, জেনারেটর, ট্রলি ভ্যান, বিশেষ টর্চ এবং ওভারহেড তার মেরামতির জন্য টাওয়ার ভ্যান তৈরি থাকছে। পূর্ব রেলের শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখাতেও বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। দু’টি জ়োন মিলে প্রায় ৯৫টি মেল-এক্সপ্রেস ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। ওড়িশায় আটকে পড়া যাত্রীদের ফিরিয়ে আনতে বৃহস্পতিবার ৩টি বিশেষ ট্রেন চালানো হয়। তার মধ্যে একটি ট্রেন পুরী থেকে বেলা ২টোয় ছেড়ে রাত পৌনে ১২টায় শালিমারে পৌঁছয়। তাতে প্রচুর পর্যটক ছাড়াও ছিলেন ভুবনেশ্বরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা। যাত্রীদের সাঁতরাগাছি, শালিমার এবং হাওড়া থেকে কলকাতার বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে রাজ্য পরিবহণের তরফে ৩৫টি অতিরিক্ত বাস চালানো হয়। শুক্রবার ৩০ জোড়া লোকাল ট্রেনও বাতিল করেছে দক্ষিণ পূর্ব রেল।
দুপুর থেকে ওড়িশার উপকূলে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়। নিচু জায়গা থেকে মানুষকে সাইক্লোন আশ্রয় কেন্দ্রে সরাতে শুরু করে প্রশাসন। খাবার, জলের ব্যবস্থা আছে সেখানে। সরানো হচ্ছে ৪ লক্ষের বেশি মানুষকে। তৈরি রাখা হয়েছে এনডিআরএফ, পুলিশ ও তটরক্ষীদের।
নিচু এলাকার প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রশাসনও। এর মধ্যে ১৮-২০ লক্ষ মানুষের সাময়িক আশ্রয়ের জন্য ৪,০৭১টি সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র ও এলাকার স্কুলবাড়িগুলিকে তৈরি রাখা হয়েছে। বাকিদের বলা হয়েছে উপকূল এলাকা থেকে ভেতরে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে চলে যেতে। বৃহস্পতিবার থেকেই সব স্টিমার ও জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। কক্সবাজারে পর্যটকদের সতর্ক করা হয়েছে। তৈরি রাখা হয়েছে সেনাদের। শনিবারের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষাও স্থগিত রাখা হয়েছে।