Tripura Assembly Election 2018

শক্ত ঘাঁটি উপজাতীয় এলাকাও দূরে ঠেলল সিপিএমকে

ত্রিপুরার ইতিহাস বলছে, উপজাতীয় এলাকায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বড় সাথী ছিলেন এখানকার মানুষ। তাঁরা না থাকলে বামপন্থী আন্দোলন ত্রিপুরায় দানা বাঁধতে পারত না। এর সব থেকে বড় প্রমাণ দশরথ দেব। তাঁকে বলা হত উপজাতীয়দের ‘মুকুটহীন সম্রাট’।

Advertisement

তাপস সিংহ

আগরতলা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ২৩:০৪
Share:

ত্রিপুরায় সিপিএম সমর্থকদের ভিড়। ছবি: পিটিআই।

বিজেপির রাজ্য সদর দফতরের ভিতরে-বাইরে তখন উত্তাল স্লোগান, ‘জয় ভারতমাতা কি জয়’! হলঘরে বিরাট টিভি স্ক্রিনের সামনে জনতার ভিড়। ত্রিপুরার একের পর এক বিধানসভা কেন্দ্রের ফলের প্রবণতা জানা যাচ্ছে আর জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ছে, আলিঙ্গনাবদ্ধ হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে। বিলি হচ্ছে লাড্ডু।

Advertisement

মাঝে মাঝেই স্লোগান উঠছে, ‘জয় ভারতমাতা কি জয়’! সে স্লোগানের উচ্চকিত স্বর কত ডেসিবেলে উঠেছিল কে জানে, কিন্তু দেখা গেল, বিজেপি নেতৃত্ব হাত নেড়ে উত্তাল সেই জন-আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন!

শুধু সেখানেই নয়, আগরতলা শহরের গণনাকেন্দ্র উমাকান্ত অ্যাকাডেমির বাইরের মাইকে প্রতিটি রাউন্ডের ফলের প্রবণতা ঘোষণার সময়েই বিজেপি-আইপিএফটি জোটের ভিড় মাঝে মাঝেই ওই স্লোগান তুলছে।

Advertisement

তবে, এটা নিছকই স্লোগান।

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, দেশের আর সর্বত্র বিজেপি যে হিন্দু তাস খেলে বা ভারতীয়ত্বের জিগির তোলে, এই ত্রিপুরায় তারা সে ভাবে তা তোলেনি। আর তুললেও অত্যন্ত নিচু পর্দায় রেখেছে। এর কারণ কী? বিভিন্ন মহলে কথা বলে এর বিভিন্ন কারণ উঠে আসছে।

এ বারের ত্রিপুরা জয়ের জন্য বিজেপির পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। হিন্দু-মুসলমান অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ এখানে নেই। বিজেপি জানত, উপজাতীয় এলাকাই হল সিপিএমের সবথেকে শক্তিশালী ভিত। অতএব, প্রথম আঘাত হানতে হবে সেখানেই। ত্রিপুরা বিধানসভার মোট ৬০টি আসনের মধ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ২০টি আসন। আরও ১০টি আসন রয়েছে তফসিলি জাতির জন্য।

উপজাতীয় এলাকা দখলের জন্য সহযোগী হিসেবে বিজেপির প্রয়োজন ছিল এমন কোনও দলকে যারা কার্যকরী ভাবে সিপিএমকে টক্কর দিতে পারবে। ১৯৯৭ সালে গঠিত হয়েছিল ইন্ডিজেনাস পিপল’স ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি)। পরে ২০০৭-এ সেটির পুনরুজ্জীবন ঘটান নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা, যিনি ‘এন সি’ নামেও পরিচিত। উপজাতিদের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট প্রভাবও রয়েছে।

ত্রিপুরায় আইপিএফটি-এর মিছিল।— ফাইল চিত্র।

সেই আইপিএফটি-কে নিয়ে বিজেপি উপজাতীয় এলাকা দখলে ঘুঁটি সাজায়। আর্থিক ও সাংগঠনিক সহায়তা দিয়ে বিজেপি এই সংগঠনকে নিয়ে যায় একেবারে বুথস্তর পর্যন্ত। কারণ বিজেপি জানত, স্বশাসিত জেলা পরিষদ (অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল) এলাকায় সিপিএমের সংগঠন অত্যন্ত পোক্ত। তিন-তিন বার এডিসি-র নির্বাচনে সব ক’টি আসনই দখল করেছে সিপিএম।

আরও পড়ুন: বামের ধস, রামের উত্থান, কেন এত চমকে দিল ত্রিপুরা

জনজাতির তোলা পৃথক ‘টিপরাল্যান্ড’-এর দাবি না মানলেও বিজেপি তাদের বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। বিজেপির এই পরিকল্পনা যে অত্যন্ত সফল হয়েছে তার প্রমাণ, এ বার যে ন’টি আসনে আইপিএফটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তার মধ্যে আটটি আসনেই তারা জয়ী হয়েছে। সিপিএম তাদের কোনও ভাবেই আটকাতে পারেনি।

নিজেদের শক্ত ঘাঁটি, উপজাতি এলাকাতেই এ ভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মানতে পারছেন না সিপিএমের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা মনে করছেন, পাহাড়ে উপজাতি এলাকায় সংগঠন যে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে তা এলাকার নেতা-কর্মীরা বুঝতে পারলেন না কেন? কেন বুথস্তর থেকে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে খবর পৌঁছল না যে, বড় রকমের ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে? বস্তুত, সিপিএম নেতাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তাঁদের দলীয় সংগঠন এতটাই পোক্ত যে সেখানে কেউ ছুঁচও ফোটাতে পারবে না!

আরও পড়ুন: ত্রিপুরাছাড়া করার হুমকি হিমন্তের, সেই মানিকেরই আশীর্বাদ নিলেন বিপ্লব

যদিও একেবারে কেউই এ কথা বোঝেননি তা নয়। যেমন, নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত সিমনা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী প্রণব দেববর্মা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘‘উপজাতীয়দের বোঝানোটা খুব কঠিন। কারণ, পৃথক রাজ্যের দাবিটা তাঁদের কাছে ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ বিষয়। তাঁদের খুব সাবধানে বোঝাতে হচ্ছে কেন আলাদা রাজ্য পেলেও ভাল হবে না। আর তা কী করেই বা সম্ভব? আমাদের কাজটা এ বার খুব কঠিন।’’

আর সেখানেই আইপিএফটি প্রার্থী বৃষকেতু দেববর্মা আঙুল তুলে রাস্তা দেখিয়ে বলেছিলেন, রাস্তার হাল দেখুন। স্বাস্থ্যের হাল দেখুন, শিল্প খুঁজতে দূরবীন লাগবে! এর নাম উন্নয়ন?’’ তিনি না হয় বিরোধী প্রার্থী। এমন অভিযোগ তুলতেই পারেন। কিন্তু বিভিন্ন উপজাতীয় এলাকায় এই প্রশ্ন ছিল সাধারণ মানুষেরও। এই প্রশ্ন সিপিএম নেতৃত্বের কান পর্যন্ত পৌঁছয়নি, এটা মেনে নিলে বুঝতে হয়, সিপিএমের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

কেন এমন হল? সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাশ স্বীকার করে নিলেন, ‘‘সংরক্ষিত আসনগুলিতে ফল অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। মেজর সেটব্যাক। আমাদের এর কারণ গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।’’

অথচ ত্রিপুরার ইতিহাস বলছে, উপজাতীয় এলাকায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বড় সাথী ছিলেন এখানকার মানুষ। তাঁরা না থাকলে বামপন্থী আন্দোলন ত্রিপুরায় দানা বাঁধতে পারত না। এর সব থেকে বড় প্রমাণ দশরথ দেব। তাঁকে বলা হত উপজাতীয়দের ‘মুকুটহীন সম্রাট’। ’৭৮ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে উপজাতীয়দের জন্য সম্পূর্ণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এর ফ‌লে ধীরে ধীরে আর এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। আগরতলার মহারাজা বীরবিক্রম কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক মিহির দেব বলছেন, ‘‘ওই সংরক্ষণের ফলে উপজাতীয়দের মধ্যে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। তাদের একাংশ পড়াশোনা করে, চাকরিও পায়। সেটা ভাল দিক। কিন্তু আর যারা সে সুযোগ পায়নি তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যেটাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বলা চলে।’’

এরই পাশাপাশি মিহিরবাবু বলেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার উপজাতীয়দের জন্য প্রচুর কিছু করেওছে। যেমন, মধ্যবিত্ত বাঙালিদের জন্যও করেছে। কিন্তু কোথাও একটা বিশ্বাসঘাতকতাও লুকিয়ে রয়েছে। হয়তো যাদের দেখে সিপিএম-মুখ মনে হয়েছে, তাদের হাতটা আসলে বিজেপি। এটা ধরতে পারাটা দরকার ছিল।’’

ইতিহাসবেত্তারা বলছেন, এই ত্রিপুরার পাহাড়েই এক সময় তীব্র জনশিক্ষা আন্দোলন হয়েছে। উপজাতীয়দের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দাবিতে সেই আন্দোলনে অগ্রণী ছিলেন দশরথ দেব, হেমন্ত দেববর্মা, বিদ্যা দেববর্মা, সুধন্য দেববর্মা-সহ অনেকেই। সেই আন্দোলন দমন করতে নামাতে হয় সেনাবাহিনী। সেই পাহাড়েই এখন প্রায় সাড়ে চারশো স্কুল হয়েছে।

কিন্তু ইতিহাসও তো পাল্টে যায়। পাল্টাতে থাকে। পরিস্থিতি আর প্রয়োজনভিত্তিক ইতিহাস ভারতীয় রাজনীতির প্রয়োজনে বহু বারই পরিবর্তিত হয়েছে। হচ্ছেও। এই মর্মান্তিক সত্যটা এই মুহূর্তে মানিক সরকারের দলের থেকে ভাল আর কে-ই বা বুঝবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement