—ফাইল চিত্র।
সারা দেশকে ঘরবন্দি না-করে এলাকা ভিত্তিক কড়া লকডাউন। তুলনায় পোক্ত স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো। সামাজিক সুরক্ষায় জোর। আর চাহিদাকে চাঙ্গা করতে যথাসম্ভব সরকারি লগ্নি। মূলত এই চার প্যাঁচেই করোনার সঙ্গে কুস্তি লড়ে বৃদ্ধির রুপোলি রেখা দেখতে পাচ্ছে চিন। অথচ কার্যত তার উল্টো পথে হাঁটা এ দেশের অর্থনীতিকে এখনও খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত।
আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে সঙ্কুচিত হতে পারে ভারতের অর্থনীতি।সেখানে বিশ্বের একমাত্র প্রধান অর্থনীতি হিসেবে বৃদ্ধির মুখ দেখতে পারে চিন। যে পড়শি মুলুককে বৃদ্ধির হারে টেক্কা দেওয়ার কথা মোদী জমানায় বার বার বলেছে দিল্লি।
জেএনইউয়ের অধ্যাপক জয়তী ঘোষের কথায়, “করোনা রুখতে দেশ জুড়ে দীর্ঘ লকডাউনের পথে হাঁটেনি বেজিং। বরং তার বদলে সংক্রমণ ছড়ানো এলাকায় কড়া লকডাউন হয়েছে। সেখানে বেশি পরীক্ষা, সংক্রমিতদের গতিবিধি জরিপ করা, তাঁদের আলাদা করা এবং চিকিৎসা—এই ভাবে চেষ্টা হয়েছে অঙ্কুরেই সমস্যা বিনাশের। অথচ সংক্রমিতের সংখ্যা নগণ্য থাকাকালীন দীর্ঘ লকডাউনের পথে হেঁটেছে ভারত। যা সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে অর্থনীতিকে।”
অনেক অর্থনীতিবিদের অভিযোগ, ওই লকডাউনে বহু জনের কাজ গিয়েছে। ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে বহু ছোট শিল্পের। তলানিতে ঠেকেছে চাহিদা। আবার পণ্য তৈরির যে জোগান-শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেন) থাকে, তা-ও ছিঁড়ে গিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। বিশেষত যেখানে ভারতে এখনও পণ্য উৎপাদনের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে অসংগঠিত শিল্প। নতুন করে নগদ জুটিয়ে, কাঁচামাল-যন্ত্রাংশ-কর্মী এনে কাজ শুরু করা তাদের পক্ষে সহজ নয়।
দুই ছবি
• প্রথম তিন মাসে ৬.৮% সঙ্কোচনের ধাক্কা সামলে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৩.২% বৃদ্ধি চিনে। আইএমএফের পূর্বাভাস, বছর শেষে প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে বৃদ্ধির মুখ দেখবে একমাত্র চিনই (১%)। ভারতের প্রকৃত জিডিপি সরাসরি ৪.৫% কমার আশঙ্কা।
• লকডাউন শিথিলের পরেও জুনে (গত বছরের একই সময়ের তুলনায়) ভারতে শিল্পোৎপাদন কমেছে ১৬.৬%। সেখানে জুলাই মিলিয়ে টানা পাঁচ মাস চিনে কল-কারখানার উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী। বাড়ছে শিল্পে মুনাফার হারও। জুনে ১১.৫%, ২০১৯ সালের মার্চের পরে সর্বোচ্চ।
• জুলাইয়ে চিনে গাড়ি বিক্রি বেড়েছে ১৬.৪%। টানা চার মাস তা ঊর্ধ্বমুখী। অথচ ভারতে ডিলারদের সংগঠন ফাডা-র তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে যাত্রী ও বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি কমেছে ২৫.১৯% ও ৭২.১৮%।
• জুনে ভারতের অশোধিত তেল আমদানি ২০১৯ সালের জুনের তুলনায় প্রায় ১৯% কম। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির পরে সর্বনিম্ন। জুলাইয়েও শোধিত তেলের চাহিদা কম ১১.৭%। সেখানে জুনে শুধু সৌদি আরবের কাছেই ১৫% অশোধিত তেল বেশি কিনেছে চিন। আমদানি বিপুল রাশিয়া, ব্রাজিল, নরওয়ে, অ্যাঙ্গোলা থেকেও।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতি বলছেন, “করোনা ঠেকাতে উহানে ৭৬ দিনের কড়া লকডাউন করেছিল বেজিং। কিন্তু সারা দেশে করেনি। যখন যেখানে বেশি সংক্রমণ মিলেছে, সেই জায়গাকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চেষ্টা হয়েছে চিকিৎসা-পরিকাঠামো বৃদ্ধির।”
১.১ কোটি জনসংখ্যার হুবেই প্রদেশের প্রধান শহর উহানে লকডাউন জারি ছিল ২৩ জানুয়ারি থেকে ৮ এপ্রিল। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেখানে তৈরি করা হয় ১,০০০ ও ১,৫০০ শয্যার দু’টি সাময়িক হাসপাতাল। কিছু দিনের মধ্যেই হাসপাতাল-শয্যা ৫,০০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২৩,০০০। হুবেইয়ের জন্য ৪,০০০ সামরিক স্বাস্থ্যকর্মী সমেত পাঠানো হয়েছিল মোট ৪৩,০০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে। লকডাউনও ছিল অনেক কড়া। দিব্যেন্দুর প্রশ্ন, দীর্ঘ লকডাউনের সুযোগে এমনিতে পিছিয়ে থাকা ভারত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বাড়িয়েছে কতখানি? প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এলাকা বেঁধে কড়া লকডাউন করে এ ভাবে চিকিৎসার বন্দোবস্ত হলে, সারা দেশকে ঘরবন্দি করার প্রয়োজন হত কি?
পার্থক্য আর্থিক নীতিতেও। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন-সহ প্রথম সারির বহু অর্থনীতিবিদ বলা সত্ত্বেও কাজ হারানো কর্মী কিংবা দরিদ্রদের এখনও সে ভাবে নগদ জোগায়নি কেন্দ্র। ২০ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্রকল্পও মূলত ঋণের সুবিধায় ঠাসা। চাহিদা চাঙ্গার লক্ষ্যে সরকারি ব্যয় নিতান্ত অল্প। জয়তীর অভিযোগ, “এমন অনিশ্চিত সময়ে অর্থনীতিকে ঠেলে তুলতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া গতি নেই। অথচ দিল্লি হাত গুটিয়ে বসে। টাকা বাড়ন্ত অধিকাংশ রাজ্যেরও।” তাঁর দাবি, এই কঠিন সময়ে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকাদের সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে ন্যূনতম আয় জুগিয়েছে চিন। বিপুল সরকারি লগ্নি করেছে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে। চিনা প্রদেশগুলি, এমনকি স্থানীয় প্রশাসনও যাতে সস্তায় ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করেছে সে দেশের সরকারি ব্যাঙ্ক। সেখানে এ দেশে রাজ্যগুলিকে ধার নিতে হচ্ছে চড়া সুদে। পাচ্ছে না জিএসটি-র টাকাও!
এমন নয় যে, চিনা অর্থনীতি সমস্যামুক্ত। বাণিজ্যে টক্কর চলছে মার্কিন মুলুকের সঙ্গে। বিপদ বাড়িয়েছে বন্যা। চাহিদা এখনও অনেক কম। অর্থনীতি মূলত মুখ তুলেছে সরকারি ব্যয়ের হাত ধরে। যা খুব বেশি হলে, দীর্ঘ মেয়াদে চড়া মূল্যবৃদ্ধি মাথা তোলার সম্ভাবনা। কিন্তু আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিতে যে ধাক্কার দরকার ছিল, জয়তীর মতে, সেটা অন্তত দিয়েছে তারা।