কংগ্রেসের ধর্নায় সনিয়া, রাহুল, মনমোহন।—নিজস্ব চিত্র।
কনুইয়ের উপর শক্ত করে বাঁধা কালো ফেট্টি! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! রিম লেস চশমার কাচ ভেদ করে যেন রাগ ঠিকরে বেরোচ্ছে! ডানের মুঠো বন্ধ করে উঁচিয়ে ধরে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘তানাশাহি নেহি চলেগা!’’
শেষ কবে সনিয়া গাঁধীকে এমন আক্রমণাত্মক দেখা গিয়েছে? সংসদের গাঁধী মূর্তির পাদদেশে ধর্না দিয়ে শেষ কবে সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছেন দশ নম্বর জনপথবাসিনী?
এই প্রথম। গোড়ায় জমি বিল ও পরে সুষমা-বসুন্ধরাদের দুর্নীতি প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে মঙ্গলবার সংঘাতের ‘মুডেই’ ছিলেন সনিয়া-রাহুল। লোকসভা থেকে প্রায় বেনজির ভাবে দলের ২৫ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করার পর এ দিন এ ভাবেই ঝলসে উঠতে চাইলেন মা-ছেলে। ‘গণতন্ত্রের হত্যা’ হচ্ছে বলে যেমন শাসক দলকে বিঁধলেন সনিয়া, তেমন রাহুলও জানিয়ে দিলেন, জমি বিল প্রশ্নে মোদী সরকারকে ঠিক যে ভাবে ‘দৌড়’ করিয়েছেন, এ বার বিজেপি-র দুর্নীতি নিয়েও তেমনই করবেন। তাঁর কথায়, ‘‘সংসদ থেকে কংগ্রেসের সব সাংসদকে তুলে ফেলে দিক সরকার। ক্ষতি নেই! বিজেপি-কে ঘেরার জন্য গোটা দেশ পড়ে রয়েছে।’’
সংসদে প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে হট্টগোল করার জন্য সোমবার কংগ্রেস সাংসদদের পাঁচ দিনের জন্য সাসপেন্ড করেছিলেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। তা আখেরে কংগ্রেসকেই রাজনৈতিক ভাবে সুবিধা করে দিল বলে মনে করছিলেন শাসক দল ও সরকারের বন্ধু দলের অনেক নেতা। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হস্তক্ষেপে স্পিকার যাতে সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেন সেই পরামর্শও তাঁদের তরফে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল সাত নম্বর রেস কোর্স রোডে। কিন্তু, নরম হওয়ার ইঙ্গিত দূরস্থান, প্রকাশ্যে অন্তত পাল্টা কংগ্রেসকে সমালোচনা করার অবস্থানে দৃঢ় থাকেন মোদী-জেটলিরা। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেসকে বিনাশকারী বলে সমালোচনা করা হয়।
যদিও সূত্রের খবর, কিছু আঞ্চলিক দলের মধ্যস্ততায় স্পিকারের তরফে কংগ্রেস নেতৃত্বকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাতেও বলা হয়েছে, সংসদে আর প্ল্যাকার্ড দেখানো যাবে না এই মুচলেখা দিলে তবেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হবে। স্বাভাবিক ভাবেই এই শর্তে বরফ গলানো সম্ভব হয়নি।
এবং ঘটনা হল, কংগ্রেস এখন বরফ গলাতেও চাইছে না। জমি বিল সংশোধনের থেকে সরকারকে পিছনের পায়ে হাঁটতে বাধ্য করার পর কংগ্রেস এখন রক্তের স্বাদ পেয়েছে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, সনিয়া-রাহুল মনে করছেন, ২৫ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করায় শাপে বর হয়েছে। জমি প্রশ্নে কংগ্রেসকে যে ভাবে আন্দোলনমুখী করে তুলতে পেরেছিলেন রাহুল, তা এতে অব্যহত রাখা যাবে। এমনিতেই সংসদের চলতি অধিবেশন শেষ হতে সাত দিনও বাকি নেই। তার পর সংসদ থেকে সড়কেই আন্দোলন নিয়ে যেতে হবে।
তা ছাড়া আরও একটি ঘটনাতেও কংগ্রেস খুশি। তা হল, এ ব্যাপারে বিরোধী দলগুলির এক কাট্টা হয়ে যাওয়া। স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আজ লোকসভা বয়কট করে তৃণমূল, এনসিপি, সংযুক্ত জনতা, আরজেডি-র মতো দল। বামেরা লোকসভা থেকে ওয়াক আউট করেন। এমনকী, সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ইঙ্গিত দেন, স্পিকারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার ব্যাপারেও ভাবনাচিন্তা করছেন তাঁরা। কিন্তু, তার থেকেও বড় হল, সংসদে বিরোধী ঐক্য ভাঙতে যে মুলায়ম সিংহের সঙ্গে বিজেপি বোঝাপড়া করছিল, আজ সেই বর্ষীয়াণ সপা নেতা লোকসভায় দাঁড়িয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। পরে সংসদের বাইরেও মুলায়ম বলেন, ‘‘সরকার সংখ্যার থাকতে বিরোধীদের দুরমুশ করতে চাইছে। এটা চলতে দেওয়া যায় না।’’
স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদ চত্বরে ধর্নায় বসার ব্যাপারে গতকালই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সনিয়া। সেই মোতাবেক এ দিন সকাল ১০টার মধ্যেই অধিকাংশ কংগ্রেস সাংসদ সংসদ ভবন চত্বরে পৌঁছে যান। কারও পরনে ছিল কালো রঙের জোব্বা। কারও হাতে সরকার বিরোধী প্ল্যাকার্ড! সওয়া ১০টা নাগাদ সেখানে একে একে এসে পৌঁছন সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ ও রাহুল গাঁধী। তার পর একটানা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে সেখানে স্লোগান তোলেন কংগ্রেস সাংসদরা। সতীর্থদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান তোলেন সনিয়াও। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সনিয়া বলেন, ‘‘সংসদ চালানো সরকারের কাজ। কিন্তু, কংগ্রেস সাংসদদের সাসপেন্ড করে গণতন্ত্রের হত্যা করেছে সরকার।’’ সুষমা-বসুন্ধরার দুর্নীতি সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক শ্রেণিকে লজ্জায় ফেলেছে বলে মন্তব্য করেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘সংসদ চালানো সরকারের কাজ। শাসক দল জানেই না কী ভাবে সংসদ চালাতে হয়।’’
তাঁরা কথা শেষ করতেই সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে আক্রমণের সুর আরও চড়িয়ে দেন রাহুল। পলাতক ললিত মোদীকে ভিসা পাইয়ে দিতে সাহায্য করে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ফৌজদারী অপরাধ করেছেন বলে ক’দিন আগে মন্তব্য করেছিলেন রাহুল। এ ব্যাপারে তাঁকে পাল্টা হুমকি দিয়ে বিজেপি-র প্রাক্তন সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী বলেছেন, রাহুল ওই অভিযোগ ফিরিয়ে নিন, নইলে মানহানির মামলা করা হবে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু, রাহুল এ দিন বলেন, ‘‘আমি আবারও বলছি, সুষমা স্বরাজ আইন ভেঙেছেন। রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে ললিত মোদীর আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে সর্বণাশ হয়েছে হাজার হাজার যুবকের।’’ মোদীকে কটাক্ষ করে রাহুল আরও বলেন, ‘‘মোদিজি কেবল নিজের মনের কথা বলেন, হিন্দুস্তানের কথা শুনতে উনি প্রস্তুত নন। কিন্তু, উনি যাতে দেশের কথা শুনতে বাধ্য হন সেই পরিস্থিতি করেই ছাড়ব।’’
কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হয়, সংসদ চত্বরে কালও তাঁদের ধর্না চলবে। চেষ্টা হচ্ছে, তাতে অন্য বিরোধী দলগুলিকেও সামিল করার। বিশেষ করে এ ব্যাপারে সিপিএম তথা বামেরা আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলেও তাঁদের দাবি।