ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। — ফাইল চিত্র
হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও রোজ ভ্যালি কাণ্ডে ত্রিপুরার রাজ্য–রাজনীতিতে খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সিপিএম তথা রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার। বিশেষ করে বিরোধী দল কংগ্রেস আক্রমণের জন্য খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে বেছে নেওয়ায় সিপিএমের অস্বস্তি আরও তীব্র হয়েছে। কার্যত সাফাই দিতে হচ্ছে মানিকবাবু ও তাঁর দলকে।
রাজ্যে রোজ ভ্যালির তৈরি একটি বিনোদন পার্ক উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি রোজ ভ্যালির ‘৭০০-৭৫০ কোটি টাকার বার্ষিক টার্ন ওভার’-এর কথা বলে রাজ্যে তাদের আরও বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা বলেন। বলেন, রাজ্যে সংস্থার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাও। কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি কোনও সংস্থার এমন গুণকীর্তন করেন, তবে সাধারণ মানুষের উপর তার প্রভাব পড়বেই। এর পরে সেই সংস্থার অর্থলগ্নির ব্যবসায় মানুষ তো আস্থা রাখবেই। বিরোধী দলের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর সার্টিফিকেটের জোরেই রোজ ভ্যালি ত্রিপুরায় তাদের বেআইনি ব্যবসা বাড়িয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই মানিকবাবু এই অভিযোগ খারিজ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন,‘‘শিশুদের জন্য একটি পার্ক উদ্বোধনে রোজ ভ্যালি আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। সাধারণত শিশুদের জন্য কোনও অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ, বিশেষ কোনও কারণ না থাকলে আমি এড়িয়ে যাই না। সে কারণেই ২০০৮ সালের জুন বা জুলাই মাসে ওই অনুষ্ঠানে যাই।’’
ওই অনুষ্ঠানে স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক দিলীপ সরকারও হাজির ছিলেন। সেখানে রোজ ভ্যালির কর্মকর্তারা ছাড়াও চলচ্চিত্র জগতের কিছু শিল্পীও উপস্থিত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘‘ওই সময়ে রোজ ভ্যালি কোনও প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত, এমন অভিযোগ কেউ করেছিল বলে আমার জানা ছিল না।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর মানিকবাবুর হয়ে এগিয়ে এসে বলেছেন, ‘‘রোজ ভ্যালির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে বিরোধী দলনেতা সুদীপ রায়বর্মন ও কংগ্রেস নেতৃত্ব যে কথা বলছেন, তা ঠিক নয়। মানিক সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করছেন বিরোধী দলনেতা।’’
কিন্তু রোজ ভ্যালির মতো একটি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি ও সেই সংস্থা সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বলা ‘ভাল ভাল’ কথা আদতে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থায় টাকা রাখতে রাজ্যের মানুষকে ‘নৈতিক ভাবে’ উত্সাহিত করেছে কিনা এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি কোনও কথা না বললেও তিনি জানান, ‘‘আমরা (মন্ত্রিসভার সদস্য) চিটফান্ডে মানুষকে টাকা রাখতে বলেছি, এমন একটা উদাহরণও কেউ দিতে পারবে না।’’ সিপিএমের কেউ এ কাজ করেছেন কি না, সে বিষয়ে তাঁর পরিষ্কার জবাব, ‘‘বিষয়টি দলের রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর বলতে পারবেন।’’ রাজ্য কংগ্রেস নেতা সুদীপ রায়বর্মনকে পাল্টা আক্রমণ করে মানিকবাবু বলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতা হতাশা থেকেই এ সব কথা বলছেন। আসলে নিজের দলের মধ্যেই তিনি সমস্যায় রয়েছেন।’’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারই ২০১৩ সালের মাঝামাঝি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের গোচরে আনে। চিটফান্ডগুলির বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের জন্য আমরাই দাবি জানাই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজরেও বিষয়টি এনেছিল রাজ্য সরকারই।’’ উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার যখন সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্তের ক্রমাগত বিরোধিতা করে গিয়েছে, তখন ত্রিপুরা সরকার ২০১৩ সালে দু’দফায় রোজ ভ্যালি-সহ রাজ্যের ৩৭টি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে চিঠি দেয়। সব ক’টি মামলার তদন্ত ভার যাতে সিবিআই গ্রহণ করে, সেই অনুরোধ জানিয়ে ২০১৪ সালে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে আলাদা করে একটি চিঠিও দেন। সুদীপবাবুদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সে কথাও মানিকবাবু ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন।
কংগ্রেসের দলনেতা সুদীপ রায় বর্মন। — নিজস্ব চিত্র
মনে করালেও এ দিকে, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য বিজিতা নাথ রোজ ভ্যালিতে টাকা রেখেছিলেন, সময় মতো সুদ-সহ অর্থ ফেরতও পেয়েছিলেন। সে কথা তিনি আবার নিজেই স্বীকার করেছেন। এ ছাড়াও, রোজ ভ্যালির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সংস্থাটির উপর নিজের আস্থার কথা জানিয়ে বিজিতা দেবী সংস্থাটির উপর সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এই ধরনের সংস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ‘ওঠাবসা’ যে সাধারণের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল, সে দাবি করে ত্রিপুরার বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের সুদীপ রায়বর্মণ বলেন, ‘‘বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিংস থেকে দেখা যাচ্ছে, রোজ ভ্যালি-সহ বিভিন্ন বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পর্ক ছিল। ২০০০ সালে রাজ্যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটি আইনও তৈরি হয়। তার পরে তা আরও কঠোর করার জন্য ‘বিধি’ও তৈরি হয়। কংগ্রেস নেতার প্রশ্ন, ‘‘এর পরেও ২০০৮ সালে রোজ ভ্যালির পার্ক উদ্বোধন করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ওই সংস্থার বার্ষিক টার্ন ওভার ৭০০-৭৫০ কোটি টাকা। বলেছেন, রাজ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে ওই সংস্থার লগ্নির সম্ভাবনার কথা, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। এ কথা বলার অর্থ কী?’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কথায় মানুষ কি ওই সংস্থায় লগ্নি করতে নৈতিক ভাবে উত্সাহিত হয়নি? এখন দায় এড়িয়ে গেলেই চলবে? যা খুশি বললেই রাজ্যবাসী মেনে নেবে?’’ সুদীপবাবুর দাবি, ‘‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার অন্য সদস্য-সহ যাঁরাই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কাজকর্মে বিভিন্ন ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, সিবিআই ও ইডি তাঁদের জেরা করুক। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক। আমানতকারীদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুক।’’ দলের কোনও নেতাকে সিবিআই জেরা করলে দলের যে আপত্তি নেই, তা সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব আগেই জানিয়ে দিয়েছে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর জানিয়েছেন, ‘‘চিটফান্ড কাণ্ডে ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। সিবিআই কাকে জিজ্ঞাসা করবে সেটাও ওরাই ঠিক করুক।’’