অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ছবি পিটিআই।
জিএসটি-র ক্ষতিপূরণ না-মিটিয়ে কেন্দ্র ধার করতে বলছে রাজ্যগুলিকে। হয় জিএসটি চালুর জন্য ক্ষতি কিংবা তার সঙ্গে কোভিড-পরিস্থিতির কারণে ক্ষতি মিলিয়ে পুরোটাই ধার করতে পারে রাজ্য। এই দুই প্রস্তাবই খারিজ করে দিতে পারে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি। কেরলের মতো বিজেপি-বিরোধী অন্য দল শাসিত রাজ্যগুলিরও আপত্তি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের জেরে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের মত।
পঞ্জাবের অর্থমন্ত্রী মনপ্রীতসিংহ বাদল জানিয়েই দিয়েছেন, কেন্দ্রের দু’টি প্রস্তাবের একটিও তাঁরা মানছেন না। ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, পুদুচেরির মতো বাকি কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিও একই পথে হাঁটতে পারে। কেরলের বাম সরকারের অর্থমন্ত্রী আইজ্যাক টমাসও জানিয়েছেন, একটি প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়াও কেন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। কংগ্রেসের পি চিদম্বরমের মতে, কেন্দ্রের প্রস্তাব দু’টি খারিজ করে সব রাজ্যেরই এক সুরে বলা উচিত, কেন্দ্রকেই জিএসটি ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দিতে হবে।
অধিকাংশ রাজ্য প্রস্তাব দু’টি খারিজ করে দিলে জিএসটি পরিষদে ফের ভোটাভুটির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। প্রয়াত অরুণ জেটলির আমল থেকে বরাবরই জিএসটি পরিষদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভোটাভুটি হয়নি। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের জমানায় প্রথম লটারির উপরে জিএসটি নিয়ে ভোটাভুটি হয়। কেরলের অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য, “আমার মনে হয়, এই বিষয়েও ভোটাভুটি হবে। জিএসটি পরিষদে ওদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।” পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী এ দিন এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন তুলেছেন, “কেন্দ্র কি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ফেলতে চাইছে?” জিএসটি পরিষদে সীতারামন বৃহস্পতিবার জানিয়ে দেন, চলতি অর্থ বছরে রাজ্যগুলির আয় ৩ লক্ষ কোটি টাকা কম হবে বলে কেন্দ্রের অনুমান। তার মধ্যে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সেস থেকে আয় হবে। বাকি ২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকার লোকসান পূরণ করা কেন্দ্রের পক্ষে মুশকিল। এর মধ্যে জিএসটি চালুর জন্য ক্ষতি ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা কোভিডের কারণে। রাজ্যের সামনে বিকল্প দু’টি। তারা ৯৭ হাজার কোটি টাকা ধার করতে পারে। অথবা পুরো ২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকাই ধার করতে পারে।
আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা হবে না রাজ্যে ।। পরীক্ষা না নিয়ে পাশ নয়: কোর্ট
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে শুধু নয়, রাজ্যের সঙ্গে তাঁর দর কষাকষির ধরনেও রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ। অমিতবাবুর প্রশ্ন, “পাঁচ ঘণ্টা ধরে বৈঠকে সকলের কথা শোনার পরে শেষ বেলায় অর্থমন্ত্রী কেন এই প্রস্তাব রাখলেন? ক্ষতিপূরণ মেটানোর দায় এড়াতে অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামত কেন লিখিত ভাবে আগে থেকেই রাজ্যকে জানানো হল না? রাজ্যও তাতে আইনি মতামত নিতে পারত।” তাঁর যুক্তি, রাজ্য যে বিকল্পই বাছুক, রাজ্যের ঋণের বোঝা বাড়বে। অর্থমন্ত্রী অতিমারিকে দৈবদুর্বিপাক বলছেন। সে ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণ মেটানো বাধ্যতামূলক। সিসৌদিয়ার অভিযোগ, রাজ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে কেন্দ্র। টমাসেরও মত, কেন্দ্রের দু’টি বিকল্পেই রাজ্যের লোকসান।
অর্থনীতিবিদ এম গোবিন্দ রাওয়ের পর্যবেক্ষণ, রাজ্যের মুশকিল হল, এখন আর জিএসটি থেকে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেন্দ্রের বদলে রাজ্যগুলি ধার নিলেও দেশের জিডিপি-র তুলনায় কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে সরকারি ঋণ বাড়বেই। গত অর্থ বছরে জিডিপি-র তুলনায় মোট সরকারি ঋণের হার ছিল ৭২.২%। চলতি বছরে এমনিতেই তা ৮৭.৬%-এ পৌঁছনোর কথা। অথচ কেন্দ্র ২০২৪-২৫-এর মধ্যে তা ৬০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে।
স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার মতে, রাস্তা তিনটি। এক, টাকা ছাপানো। দুই, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে রাজ্যগুলিকে আরও বেশি অগ্রিম ঋণ দেওয়া। তিন, ডাকঘরের বিশেষ স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প চালু করে রাজ্যের আয়ের পথ করে দেওয়া। গোবিন্দ রাওয়ের মতে, রাজ্য বাড়তি ঋণ করলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে টাকা ছাপিয়েই ঋণের জোগান দিতে হবে। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, জিএসটি ক্ষতিপূরণ মেটানোর জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ বন্ড ছাড়া হতে পারে। সরকারি ব্যাঙ্ক তা কিনে নিতে পারে। অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, এতেও বাড়তি নগদ টাকা বাজারে আসবে। তাতে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়তে পারে। এমনিতেই এপ্রিল থেকে জুলাই, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের লক্ষণরেখা, ৪ শতাংশের উপরে রয়েছে। জুলাইয়ে তা ৬.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কতখানি স্বস্তিতে থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।